ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে না

যশোর এখন ইজিবাইক ও রিক্সার শহর

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

যশোর এখন ইজিবাইক ও রিক্সার শহর

সাজেদ রহমান, যশোর অফিস ॥ যশোর শহরে চলতে পারবে দু’হাজার ৬শ’৪৫ ইজিবাইক ও আট হাজার রিক্সা। এমন তথ্য পাওয়া গেছে পৌরসভা থেকে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত এসব ইজিবাইক ও রিক্সা যাতে ঠিকমত চলাচল করে সেই ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দিয়েছেন পৌর কর্তৃপক্ষ। যশোর শহরে দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ যানজট লেগেই আছে। পথচারীরা ঠিকমত চলাফেরা করতে পারছেন না। রিক্সা কিংবা ইজিবাইকে শহরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে কাংক্ষিত সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লেগে যাচ্ছে কেবল যানজটের কারণে। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে নাকাল যশোরবাসী বিভিন্ন সময় দাবি তোলেন। স্থানীয় প্রশাসনও এ নিয়ে বহুবার আলোচনা করে। যানজটমুক্ত করতে একাধিকবার সিদ্ধান্তও নেয় প্রশাসন। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ দিন দিন বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় বর্তমান পৌর কর্তৃপক্ষ ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী গত বছর থেকে লাইসেন্স দেয়া শুরু করে। সাত হাজার টাকা গ্রহণের মাধ্যমে লাইসেন্স গ্রহণ করেন চালকরা। পৌরসভার এ আহবানে সাড়া দিয়ে মাত্র দু’ হাজার ছয়শ’৪৫টি ইজিবাইকের লাইসেন্স হয়েছে। অথচ শহরে কমপক্ষে ১০ হাজার ইজিবাইক চলাচল করে বলে পৌরসভার একটি সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য, সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পৌরসভার কাছে নেই। অপরদিকে, যশোর পৌরসভা থেকে এ যাবৎকাল আট হাজার রিক্সা চালক লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন, যারা পায়ে রিক্সা চালাবেন। এই লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্সা শহরে চলাচলে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন পৌরসভার সহকারী লাইসেন্স পরিদর্শক। কিন্তু লাইসেন্সপ্রাপ্ত পায়ের রিক্সা বর্তমানে আগের মতো নেই। ব্যাটারিচালিত রিক্সা আর ইজিবাইকের ভীড়ে তা হারিয়ে গেছে। এদিকে, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করার সিদ্ধান্তে চালকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি শহরে বিভিন্ন কাজে আসা লোকজন তেমন কোনো বাহন না পাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েন। কোনো কিছু না পেয়ে অগত্যা তাদের পায়ে হেটে গন্তব্যে পৌঁছুতে হয়েছে। আবার যারা পায়ে চলা রিক্সায় চড়েছেন তাদের গুণতে হয়েছে অন্যান্য সময়ের চেয়ে দু’তিনগুণ টাকা। এতেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন পথচারীরা। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, ইজিবাইক এবং ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল একেবারেই বন্ধ করা হলে নানা ধরনের বিশৃংখলা তৈরি হতে পারে। যা আইনশৃংখলা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে। বেকার হওয়া লোকজন জীবিকার তাগিদে অন্যায় কাজে জড়িয়ে যেতে পারেন বলে আশংকা তাদের। যশোর শহরের ব্যাপক যানজট নিরসনে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বললেও তা কার্যকর করতে পারেনি। ফলে, যানজট লেগেই ছিল। প্রতিনিয়ত নাকাল হচ্ছিলেন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসন ফের ব্যাটারিচালিত যানবাহন শহরে চলাচল নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তেই পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ স্বস্তির আশা করেছেন। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা ব্যক্ত করেন দুর্ভোগে পড়ার। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, অপেক্ষাকৃত কম খরচে তারা শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলাচল করতে পারেন। কেবল তাই না, অর্থ সাশ্রয়ের সাথে সময়ও বাচে। এ কারণে তারা ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা শৃংখলার মধ্যে চলাচলের অনুমতির পক্ষে মত দিয়েছেন। তাছাড়া, বর্তমানে কয়েক হাজার মানুষ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সার ওপর নির্ভরশীল। এই বাহনের ওপর ভর করে তাদের জীবন-জীবিকা চলে। অনেকেই অন্ধকার পথ থেকে ফিরে এসে ইজিবাইক চালিয়ে সৎ জীবনযাপন করছেন। আবার অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ব্যক্তি ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। অন্য কিছু করে যা করা সম্ভব না। এগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হলে তাদের কী হবে? এ ধরনের প্রশ্নও ছুড়েছেন নগরবাসীর কেউ কেউ। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, হটকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল এভাবে বন্ধ করে দেয়া হলে যাত্রীদের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়বে। এ ধরনের বক্তব্য, পায়ে চালানো রিক্সা চালকদেরও। রিক্সা চালকরা বলছেন, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা অবাধে চলাচল করার কারণে পায়ে চালানো রিক্সার সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করে অর্ধেকের বেশি ইজিবাইক এবং সবগুলো ব্যাটারিচালিত রিক্সা একসাথে বন্ধ করলে মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাবে। কারণ পায়ে চালানো যতগুলো রিক্সা এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইজিবাইক থাকবে তা দিয়ে শহরের মানুষের প্রয়োজন মেটানো দায় হয়ে পড়বে। কারণ, যাত্রীরা প্রয়োজনে সময় মতো বাহন পাবে না। আর এই সুযোগটি কাজে লাগাবে অনুমতি পাওয়া চালকরা। তখন তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করবে বলে মনে করেন পায়ে চালানো রিক্সা চালক তমিজ উদ্দিন, আফসার আলী, সাহেব আলী, সোহরাব, ফরিদসহ অনেকেই। বৃহস্পতিবার শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাড়তি ভাড়া আদায় করার দৃশ্যও চোখে পড়ে। ইজিবাইকে যেখানে পাঁচ টাকায় যাওয়া যেত সেখানে যেতে একজনের কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লেগেছে। শহরে দু’একটি ইজিবাইক চলাচল করলেও ব্যাটারিচালিত রিক্সা একেবারেই ছিল না। তবে, পায়ে চালানো রিক্সার সাথে ভ্যান ও মাহেন্দ্র চলাচল করেছে দাপটের সাথে। এসব বাহনের চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেছে চোখের পর্দা ফেলে। বেশিরভাগ চালক দু’থেকে চার পাঁচগুণ বেশি ভাড়া নিয়েছেন। বেকায়দায় পড়া যাত্রীদের না দিয়েও কোনো উপায় ছিল না। এ কারণেই যত ক্ষোভ। পায়ে চালানো কয়েকজন রিক্সা চালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ব্যাটারি খুলে ওই রিক্সা পায়ে চালালে শহরে ঘাটতি পূরণ হবে কি না। তার জবাবে তিনি বলেন, সেটি সম্ভব না। কারণ হিসেবে এসব চালক বলছেন, পায়ে চালানো রিক্সার বডি আর ব্যাটারিচালিত রিক্সার বডি দু’ রকম। ব্যাটারিচালিত রিক্সার বডি অত্যন্ত ভারী। ফলে, ওই রিক্সা পায়ে চালানো যাবে না। একইসাথে অভ্যাসের একটি ব্যাপার রয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালাচ্ছেন তারা রাতারাতি পায়ে চালানো রিক্সা চালাতে পারবেন না। চালক ও সাধারণ মানুষের বক্তব্য, শুরুতেই বন্ধ করা হলে হাজার হাজার মানুষ আজ বেকায়দায় পড়তো না। অনেকেই সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে এসব যানবাহন কিনেছেন। তারা গাড়ি চালিয়ে প্রতি সপ্তাহে কিস্তির টাকা পরিশোধ করে থাকেন। এ অবস্থায় গাড়ি চালাতে না পারলে কীভাবে ঋণ শোধ করবেন তা নিয়ে মহাচিন্তায় পড়েছে খেটে খাওয়া এসব মানুষ। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ বলছেন, একবারে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল বন্ধ না করে এগুলোকে শৃংখলার মধ্যে আনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তা না হলে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব পড়তে পারে। যারা এতদিন ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিল তাদের অনেকেই জড়িয়ে পড়বে চুরি, ছিনতাই আর ডাকাতির মতো কাজে। যা সাধারণ মানুষের স্বস্তি কেড়ে নেবে। বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও। এদিকে, বন্ধের প্রতিবাদে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সার চালকরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে একাধিক চালক জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, রুটি রুজি বন্ধ হয়ে গেলে আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া তাদের কী ই বা করার আছে। সবমিলিয়ে স্বস্তি-অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন শহরবাসী।
×