ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী

শান্তি আছে বলেই পার্বত্য এলাকায় আজ উন্নয়নের ছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

 শান্তি আছে বলেই পার্বত্য এলাকায় আজ উন্নয়নের ছোঁয়া

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তি চুক্তি প্রসঙ্গে বলেছেন, পার্বত্য এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় আছে বলেই সেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সরকার উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালাতে পারছে। রাস্তাঘাট গড়ে উঠেছে। সুষম উন্নয়নের অংশীদার হয়েছে পার্বত্য জনপদের বাসিন্দারা। তাই সেখানকার বাসিন্দাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করার উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী তার সরকারী বাসভবন গণভবনে শান্তি চুক্তির দু’দশক পূর্তি অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলাবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এতো দ্রুত এভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে কি-না, আমার জানা নেই। চুক্তির ৭২ শর্তের মধ্যে ৪৮টিই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। চুক্তির সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ভূমি বিরোধ, সেই জটিলতাও শীঘ্রই সমাধান হবে। এক্ষেত্রে পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করেন সরকারপ্রধান। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্যবাসীদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারাই ওখানে বসবাস করছেন, সকলকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। সুন্দরভাবে, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সকলে শান্তিতে বসবাস করবেন যাতে আমরা সার্বিক উন্নতি করতে পারি। সবাই মনে রাখবেন যে কোন উন্নয়নের পূর্বশর্তই হচ্ছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। বর্তমান সরকার পার্বত্য এলাকাসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যেভাবে হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়, তেমনি পার্বত্য এলাকায়ও আত্মঘাতী সংঘাত শুরু হয়। একটা সময় ছিল, পার্বত্য এলাকায় গেলেও দুপুর ৩টার মধ্যেই ফিরে আসতে হতো। তখন বুঝলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সমস্যা এটা রাজনৈতিক সমস্যা। এর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিই। আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয়ে সেল গঠন করি এবং নিজেও উদ্যোগ নিই। এরমধ্যে মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটত তা অগ্রহণযোগ্য ছিল। দ্বন্দ্বটা যেন আরও বাড়ানোর অপচেষ্টা ছিল। একটা পর্যায়ে আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি চুক্তি করতে সমর্থ হই। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তিতে সই করি। তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে যারা সংঘাতে জড়িত ছিল, আমরা তাদের অস্ত্রসমর্পণের সুযোগ দিই। স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরে আসার সুযোগ দিই। সংঘাতের কারণে যে বাসিন্দারা ভারতে শরণার্থী হয়ে যান, তাদের ফিরিয়ে আনি। তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিই, যেটার দায়িত্ব থাকে আমাদের সেনাবাহিনীর হাতে। চাকরি ছেড়ে যাওয়া অনেককে নীতিমালা শিথিল করে ফের চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দিই। এ চুক্তি সইয়ের ক্ষেত্রে বাধা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চুক্তির পর আমরা যেদিন অস্ত্র সমর্পণের অনুষ্ঠান করি, সেদিন বিএনপি হরতাল ডাকে। অস্ত্র সমর্পণে বাধা দেয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আমার মনে হয় তারা অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা কত অপপ্রচার করেছিল। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন চুক্তি হলে পুরো ফেনী পর্যন্ত ভারতের অংশ হয়ে যাবে। এমনকি ভারতের একটি পতাকাও তারা বানিয়েছিল, যেটা আমাদের গোয়েন্দারা চিহ্নিত করে ফেলেন। সব বাধা পেরিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান মেনে সই হওয়া এই চুক্তির উদ্দেশ্য পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়ন, এখানকার মানুষের জীবনমান উন্নত করা। আজকে সাজেক ভ্যালি পর্যন্ত সরাসরি গাড়িতে যাওয়া যায়। স্বাধীনতার আগে মূল রাস্তা থেকে সাত দিন হেঁটে যেতে হতো সাজেক ভ্যালিতে। এখন যেমন রাস্তাঘাট হয়ে গেছে, তেমনি ওই অঞ্চলের মানুষ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলমূল সব বাজারজাত করতে পারছে। প্রধানমন্ত্রী পার্বত্যাঞ্চলে উন্নয়নের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, সেখানে পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছি। ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়িয়েছি। রাস্তাঘাট করতে গিয়ে ক’দিন আগেই থানচিতে আমাদের সেনা সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। চুক্তির বাইরেও সরকার পার্বত্য জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে পার্বত্যবাসীর জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছি। দেশে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। সেজন্য পার্বত্য জনপদকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করারও ব্যবস্থা নিয়েছি, যেন আমাদের সন্তানেরা নিজেদের এলাকায় থেকেই পড়াশোনা করতে পারে। এ সময় চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির জনক এই দেশের মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যখন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখনই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। একই সঙ্গে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তখন থেকেই পাহাড়ে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চিন্তা করেছি, এখানে অশান্ত কেন? তাই আমরা পাহাড়ে শান্তি আনার জন্য এই চুক্তি করেছি। তিনি বলেন, বিএনপি এখানে সমতল ভূমি থেকে অনেক মানুষ এনেছিল। এরপরও শান্তি হয়নি। আমরা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ৩০টি বিষয় হস্তান্তর করেছি। আমরা ডিজিটাল ফোনের ব্যবস্থাসহ পাহাড়ের সবস্থানে মোবাইল ফোনের ব্যবস্থা করেছি। আমরা এই অঞ্চলের শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৪টি কলেজকে সরকারীকরণ করেছি, মেডিক্যাল কলেজ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছি। এখানে আরও আবাসিক স্কুল করা হবে। এখানের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছেলে মেয়েরা মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, চুক্তির যেসব বিষয় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি তা আলাপ আলোচনার মধ্যেমে করা হবে। চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে সংবিধানের বাইরে কিছু করা যাবে না। ভিডিও কনফারেন্সে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বক্তব্য দেন।
×