ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জড়িতদের ধরতে পৃথক ডেটাবেজ হচ্ছে ॥ চলছে কূটনৈতিক তৎপরতা ও ইন্টারপোলের রেড ওয়ারেন্ট

অর্থপাচারে জড়িত দেশী বিদেশী ৪৫ প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গেছে

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

অর্থপাচারে জড়িত দেশী বিদেশী ৪৫ প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গেছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অর্থ পাচারে জড়িত ব্যক্তি ও দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের পৃথক ডেটাবেজ তৈরি হচ্ছে। ডেটাবেজে থাকছে অর্থ পাচারকারী ও অর্থ পাচারে জড়িত প্রতিষ্ঠানের নাড়িনক্ষত্রের তথ্য। ইতোমধ্যেই সংগৃহীত তথ্যের একটি খসড়া ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। সেই ডেটাবেজে অর্থ পাচারে জড়িত দেশী-বিদেশী ৪৫ প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। ইতোমধ্যেই পাচারকারী ও পাচারের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আগাম সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। অর্থ পাচারের ঘটনায় দায়েরকৃত দুই শতাধিক মামলার তদন্ত চলছে। মামলার আসামিদের গ্রেফতারে দেশ-বিদেশে জোরালো অভিযান, কূটনৈতিক তৎপরতা ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড ওয়ারেন্ট জারির কাজ চলছে। সিআইডির একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সিআইডির সংশ্লিষ্ট এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, দক্ষ জনবলের অভাবে অনেক অর্থ পাচার মামলার তদন্ত থেমে আছে। ইতোপূর্বে এত মুদ্রা পাচারের মামলা তদন্তের জন্য সিআইডির কাছে আসার রেকর্ড নেই। যা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় মুদ্রা পাচারের ঘটনা আগের তুলনায় বেশি উদঘাটিত হচ্ছে। এজন্য তুলনামূলকভাবে বেশি মামলা রেকর্ড হচ্ছে। তদন্তাধীন মামলার অভিযোগ মোতাবেক কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই দুটি মামলার চার্জশীট দাখিল করা হচ্ছে। মামলা দুটির অন্তত ৫ থেকে ৭ আসামি বিদেশে পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতার করতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার ও সিআইডির মুখপাত্র মোল্লা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, প্রযুক্তির মাধ্যমে ভুয়া মাস্টার কার্ড তৈরির ফলে অর্থ পাচারের ঘটনা তুলনামূলক বেশি উদঘাটিত হচ্ছে। এমনই একটি চক্রের সদস্য চার ছাত্র ও এক বিকাশ এজেন্ট চলতি বছর ৮ আগস্ট তাদের হাতে গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে ১৪১ প্রিপেইড মাস্টার কার্ড উদ্ধার হয়। গ্রেফতাররা অর্থ পাচারের অভিযোগ স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দী মোতাবেক গ্রেফতারকৃতরা অনলাইনে পাচারকারীদের জন্য ভুয়া এ্যাকাউন্ট খুলত। সেই এ্যাকাউন্টে পাচারকারীদের চাহিদা মোতাবেক টাকা ডলারে রূপান্তর করে দিত। অনলাইনে করা এ্যাকাউন্টের ওপর বাংলাদেশের কোন ব্যাংকেরই মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। ওই এ্যাকাউন্ট মোতাবেক তৈরি করে দেয়া হতো প্রিপেইড মাস্টার কার্ড। এসব কার্ড তৈরি করে দেয়ার সঙ্গে জড়িত স্ক্রিল, পাইওনিয়ার, নেটেলার ও ফার্স্টচয়েসসহ কয়েকটি বিদেশী কোম্পানি। মাস্টার কার্ডের ব্যবসার আড়ালে অর্থ পাচারের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পেপাল, পারফেক্ট মানি, ওয়েব মানি ও বিট কয়েন নামে কয়েকটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাজ করার তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত প্রিপেইড মাস্টার কার্ডগুলো পাইওনিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি হয়ে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসে। এসব কার্ড কুরিয়ার সার্ভিস ও ডাকযোগে পাঠানো হয়ে থাকে। কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত। যারা বাংলাদেশ থেকে এসব প্রিপেইড মাস্টার কার্ড তৈরির জন্য বিদেশে অর্ডারসহ এ্যাকাউন্টধারীদের তালিকা পাঠায়, চক্রটি তাদের একটি নামীয় তালিকা কুরিয়ার সার্ভিস বা পোস্ট অফিসের সংশ্লিষ্ট ওসব অসাধু কর্মকর্তার হাতে আগাম পৌঁছে দেয়। কার্ডগুলো আসা মাত্রই সেগুলো কুরিয়ার সার্ভিস ও পোস্ট অফিসের অসাধু চক্রের সদস্যরা সংগ্রহ করে। এরপর তারা যাদের নামে কার্ড তাদের কাছে পৌঁছে দেয়। প্রিপেইড মাস্টার কার্ড তৈরির ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় বিদেশী কোম্পানিগুলো চাহিদা মোতাবেক মাস্টার কার্ড তৈরি করে চক্রের দেয়া ঠিকানা মোতাবেক পাঠিয়ে দেয়। যে নামে মাস্টার কার্ডগুলো আসে সেই নামে আদৌ কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে আছে কিনা বা কোন দিন ছিল কিনা সে তথ্যের প্রয়োজন হয় না। যার নামে মাস্টার কার্ড তৈরি হয়, তার পরিচয় নিশ্চিত করার কোন প্রয়োজনীয়তা বা বাধ্যবাধকতা নেই। কার্ডে পাচারকারীদের চাহিদা মোতাবেক বৈদেশিক মুদ্রা রিচার্জ করে দেয় চক্রটি। সেই মাস্টার কার্ড মানিব্যাগে ভরে বা পকেটে করে বিমানবন্দর দিয়ে অনায়াসে অর্থ পাচারকারীরা তাদের পছন্দের দেশে চলে যায়। ধরা পড়ার ন্যূনতম কোন সুযোগ থাকে না। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগে মাস্টার কার্ড, এটিএম কার্ড বা এ ধরনের ব্যবহার্য সামগ্রীর কোন চেকিং হয় না। মাস্টার কার্ড কম্পিউটারে চেক করে তাতে কত অর্থ আছে বা দেশে ফেরার পর খরচ শেষে কত অর্থ কার্ডে রয়েছে তার কোন চেকিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এমন সুযোগ নিয়েই অর্থ পাচারকারীরা এক বা একাধিক প্রিপেইড মাস্টার কার্ড নিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে গিয়ে অর্থ পাচার করে আবার দিব্যি দেশে ফিরছে। বিষয়টি কারও নজরেই আসছে না। যে কারও এটিএম কার্ডের গোপন পিন নম্বর জানা থাকলে যেমন টাকা তোলা সম্ভব তেমনকি মাস্টার কার্ডের পিন নম্বর জানা থাকলে যেকোন ব্যক্তি টাকা স্থানান্তর বা অর্থ উত্তোলন করতে পারেন। এক্ষেত্রে যার নামে কার্ড তৈরি হয়েছে বা যিনি কার্ড ব্যবহার করে অর্থ তুলছেন, সেই ব্যক্তি এক না হলেও কোন সমস্যা নেই। বরং পাচারকারীদের জন্য এটি বাড়তি সুবিধা। কারণ যিনি অর্থ পাচার করছেন তিনি আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন। এই ফাঁকে বেনামে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারণ যে কার্ড দিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে, সেটি পাচারকারীর নামে নয়। বেনামে। এজন্য শত চেষ্টা করেও বেনামে তৈরি মাস্টার কার্ডের মাধ্যমে অর্থ পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। পাচারকারীদেরও আর সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। সিআইডি কর্মকর্তা মোল্লা নজরুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশে মাস্টার কার্ডের ব্যবসায় জড়িত দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোকে নজরদারির আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। অবৈধ মাস্টার কার্ডের ব্যবসায় জড়িত কোম্পানি ও ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে, তাদের পৃথক তালিকা হচ্ছে। এসব তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রয়োজনীয় সব জায়গায় দেয়া হয়েছে।
×