ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

হারুন হাবীবের প্রামাণ্য গ্রন্থ গণমাধ্যম ’৭১

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

হারুন হাবীবের প্রামাণ্য গ্রন্থ গণমাধ্যম ’৭১

যে ক’জন লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট মুক্তিযুদ্ধ উপজীব্য করে নিরন্তর কলম চালিয়ে যাচ্ছেন হারুন হাবীব তাদের প্রথম দিকের একজন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ভারতে চলে যান এবং পুরো ৯ মাস সীমান্তবর্তী পশ্চিম বাংলা, আসাম, মেঘালয় ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ করেন। ক্যামেরায় দুর্লভ চিত্র ধারণ করেন। আবার প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন। তার খবর, ছবি, সচিত্র প্রতিবেদন মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। বস্তুত ঊনসত্তরের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী ছাত্র-তরুণ-তরুণীদের কাছে এমনভাবে হাজির হয়েছিল যা থেকে দূরে থাকার কোন সুযোগ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পর হারুন হাবীব তার তিনটি অস্ত্রের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রটি সারেন্ডার করলেও অপর দুটি কলম ও ক্যামেরা সারেন্ডার করেননি। যুদ্ধ বিজয়ের ৪৬ বছর পরও কলম-ক্যামেরার বিশ্রাম নেই। ৩০ লাখ শহীদ ও পাঁচ লক্ষাধিক নির্যাতিত মা-বোনের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে সামাজিক-রাজনৈতিক লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছেন। রিপোর্টার থেকে বাসসের সর্বোচ্চ পদ এমডি ও চীফ এডিটরের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তার পদচারণা ছিল সাহসী এবং আপোসহীন। আজও সে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, বর্তমানে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। পাশাপাশি কলমও থেমে নেই তার। রণাঙ্গন থেকে বাসসের শীর্ষ পদেই শেষ কথা নয়। হারুন হাবীব তার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে অনেক বিদেশী গণমাধ্যমেও কাজ করেন, এখনও করছেন। ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ ‘দি ফ্রন্ট লাইন’ আমেরিকার ‘দ্য নিউজ উইক’ জার্মানির ‘ডয়েচে ভ্যালি’ প্রভৃতি। হারুন যে সব উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন (বাংলা ও ইংরেজী) তার মধ্যে রয়েছে সোনালি ইগল ও উদ্বাস্তু সময় (আত্মজৈবনিক উপন্যাস), প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম, পোস্টার ’৭১, জয়যুদ্ধের উপাখ্যান, ইতিহাসের আলোকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ-ডেটলাইট আগরতলা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ, বাংলাদেশ ১৯৭১, Bangladesh blood and bruthality, Bangaladesh Genocide, Looking beyond boundaries প্রভৃতি। এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলে প্রবন্ধের সুবিচার করা হবে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সমাজ-সাংবাদিকতা-রাজনীতি-সংস্কৃতিতে মিলিটারি তন্ত্রের যে কালোছায়া নেমে এসেছিল সে সময় আমরা যে ক’জন সাংবাদিক জাতির পিতা ও জাতীয় ৪ নেতার হত্যার বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে কলম ধরি, হারুন হাবীব তাদের মধ্যে প্রথম সারির একজন। লেখার টেবিল থেকে রাজপথে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আজও শেষ হয়ে যায়নি। এখনও গোপন অবস্থান থেকে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চলছে। হারুনের সর্বশেষ গ্রন্থ ‘গণমাধ্যম ১৯৭১, বিশ্ব সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধ’ অন্য প্রকাশ এটি প্রকাশ করেছে এবং সম্প্রতি ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে এর প্রকাশনা উৎসবে মোড়ক উন্মোচন করেন বর্তমান সময়ের পথিকৃৎ সাংবাদিক তোয়াব খান, কামাল লোহানী, মতিউর রহমান, গোলাম রহমান, হারুন হাবীব ও আমি। গণমাধ্যম ১৯৭১-এর অবয়ব হারুন হাবীব এমনভাবে সাজিয়েছেন যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে জাতির পিতার নেতৃত্বে বাঙালীর আন্দোলন, পাকি মিলিটারি জান্তা ইয়াহিয়া বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রেস সেন্সরশিপ। এখানে হারুন হাবীব ‘দানবীয় প্রেস সেন্সরশিপ’ শব্দাবলী ব্যবহার করে ভয়াবহতা তুলে ধরেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোতে তেমন কোন খবরই ছাপানো যায়নি। বেশিরভাগ তো শুরুতেই পুড়িয়ে দেয়া হয়। যেমন- দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক গণবাংলা, দ্য পিপল, স্বরাজ, আওয়াজ। কারণ এসব পত্রিকা গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলত। সংবাদ অফিসে আগুন দিলে সাংবাদিক শহীদ সাবের নিহত হন। তখন অবশ্য একটি পত্রিকা যেমন- দৈনিক সংগ্রাম নিয়মিত প্রকাশিত হতো এবং এটি মূলত মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারপত্র হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে পাকিস্তান মিলিটারি জান্তার গণহত্যা, নারী নির্যাতন, বুদ্ধিজীবী হত্যা সহযোগী আলবদর, আলশামস, রাজাকার, শান্তি কমিটির দালালদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছে। অবশ্য এসব তাদের জন্যও বুমেরাং হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় সংগ্রামে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। হারুন হাবীব তার গণমাধ্যম গ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দরভাবে আগুনে পোড়া দ্য পিপল সম্পাদক Abidur Rahman-এর একটি তথ্যবহুল রিপোর্টের মাধ্যমে পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তার Operation searchlight-এর বর্বর গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছেন। যেমন শুরুতেই বলেছে ¸ heart bleeds when I vividly reminder the tragic scenario of the fatal night of march ২৫, ১৯৭১. আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু এক অনুষ্ঠানে আবিদুর রহমানকে বলেন, I need an english language newspaper. ... Abidur Rahman, you were a journalist in early life, nwo god has given you enough resourcess. The name of the paper was selected as `the people by Bangab-andhu. আবিদুর রহমান তার রিপোর্টের মাধ্যমে দ্য পিপলস পত্রিকা পুড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার চিত্র তুলে ধরেন। বিদেশী পত্রিকার মধ্যে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার (২৭ মার্চ ১৯৭১) শিরোনাম হলো ‘জীবন্মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ।’ শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন ‘বাংলাদেশ সার্বভৌম ও স্বাধীন।’ কিন্তু হিংস্র নেকড়ের পাল ওই বাংলার ওপর হঠাৎ ঝাঁপাইয়া পড়িয়েছে। একটি জাতির স্বাধীনতার বাসনাকে তারা দলিত করিয়ে ছিঁড়িয়ে ফেলিবে এই তাহাদের আকাক্সক্ষা, এই তাহাদের নির্লজ্জ হুঙ্কার। কলকাতার দৈনিক যুগান্তর, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১। পত্রিকাটি ৪ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে শিরোনামে করেছে ‘ঢাকা বিমান ঘাঁটির রাস্তাটি গণকবরে পরিণত- ব্রিটিশ মহিলা শরণার্থী।’ সিঙ্গাপুর ৩ এপ্রিল ডেটলাইন দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ... মুক্তি সংগ্রামে ৩ লাখ লোকের মৃত্যু মোটেই অতিরিক্ত নয়... আমি একজন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসারকে প্রশ্ন করেছিলাম- শিশুদের হত্যা করছেন কেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘শিশুদের অনাথ করে রাখলে তারা বড় হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী হবে। যুগান্তর ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ আগরতলা থেকে পিটিআই- আজ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সাধারণতন্ত্র গঠিত হয়েছে। মুক্ত বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে এই রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া হয়। এই নবগঠিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ২৫ মে ১৯৭১-২৪ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বিশ্ব শক্তিগুলো যদি বাংলাদেশে গণহত্যায় লিপ্ত পাকিস্তানকে সংযত না করে তবে ভারতই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা থেকে। ১০ জুন ১৯৭১ কলেরার আক্রমণে কেবল নদীয়াতেই ছাব্বিশ হাজার শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ১৬ জুন ১৯৭১ রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শেষ পর্যন্ত আমাদের যদি জাহান্নামে যেতে হয় তবু আমরা পিছপা হব না। ১৩ জুলাই ১৯৭১, ১২ জুলাই আজ ক্রুদ্ধ লোকসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শরণ সিংহ ঘোষণা করেন, পাকিস্তানকে অনবরত অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভারত প্রতিবাদ জানিয়েছে... বর্তমান পরিস্থিতিতে অস্ত্র দেয়ার অর্থ গণহত্যাকে সমর্থন করা। এভাবে অব্যাহত সমর্থন দান শেষে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বহির্বিশ্বে বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে যান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সমর্থনে এবং বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পক্ষে বড় বড় রাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। আনন্দবাজার, ৫ নবেম্বর ১৯৭১ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৪ নবেম্বর ১৯৭১ ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে বৈঠক করেন। পয়লা ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তিবাহিনীর প্রতি সমর্থন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিল। অবশ্য তার আগেই মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে এয়ার স্ট্রাইক শুরু করে, সশস্ত্র বাহিনী সীমান্তে মার্চ করে। এমনিভাবে হারুন হাবীব তার গ্রন্থে The statesman of India, The sunday times, The Time, The Japan times; Evening standared, The Guardian, The Daily Telegraph, Mainichi Daily News, Washington Post, The Financial times, International Herald Tribune প্রভৃতি পত্রিকায় সে সময় প্রকাশিত রিপোর্ট তুলে ধরেন। হারুন হাবীব এভাবে বিশ্ব গণমাধ্যমে পুরো ৯ মাসের রিপোর্ট, পর্যালোচনা তুলে ধরেন। বিশেষ করে লন্ডনের ঞযব উধরষু ঞবষবমৎধঢ়য পত্রিকার বিখ্যাত রিপোর্টার সায়মন ড্রিংয়ের সেই সাড়া জাগানো রিপোর্ট, যার শিরোনাম ছিল In the name of God and a united Pakistan যা ব্যাঙ্কক পৌঁছে পত্রিকায় পাঠান। পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তা যখন সকল বিদেশী সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছাড়ার নির্দেশ দেন তখন সায়মন ড্রিং (বয়স ২৬ বছর) হোটেলের ছাদে আত্মগোপন করেন এবং সুযোগ বুঝে গণহত্যার খবর সংগ্রহ করেন। তার সেই রিপোর্ট ছাপা হয় ৩০ মার্চ এর ডেইলি টেলিগ্রাফে। এমনিভাবে বহু বিদেশী সাংবাদিক (ভারতীয়সহ) নিরলসভাবে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেন। কিভাবে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রহরে গণহত্যা শুরুর পর পর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন, সব তুলে ধরেন। ভারতীয় সাংবাদিকরা কাজ করেছেন যেন তাদের নিজের যুদ্ধ। হারুন হাবীব তার গ্রন্থে ভারতের বেশ কয়েকজন নামকরা রিপোর্টারের নাম উল্লেখ করেন- যেমন মানস ঘোষ, তুষার পন্ডিত, মনোজ মিত্র, অমূল্য গাঙ্গুলী, আশীষ চক্রবর্তী, অনিল ভট্টাচার্য, বরুণ সেনগুপ্ত, সুভাষ চক্রবর্তী, কিরিট ভৌমিক, মানিক চৌধুরী, উপেন তরফদার, প্রণবেশ সেন, সুনৎ মুখার্জী প্রমুখ। এরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়িয়ে ছিলেন যে তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে। ঢাকা ৩০ নবেম্বর ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ই-মেইল : [email protected]
×