ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন মেয়র আনিসুল হক

প্রকাশিত: ০৮:২৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

চলে গেলেন মেয়র আনিসুল হক

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ হাসপাতালে থেকে আর ফিরলেন না মেয়র আনিসুল হক, সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে আক্রান্ত আনিসুল হক হাসপাতাল থেকেই মৃত্যুর দেশে পাড়ি জমালেন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দশটা ২৩ মিনিটে লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে। আনিসুল হকের বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী রুবানা হক ও সন্তানরা তার পাশে ছিলেন। এর আগে সন্ধ্যায় রুবানা হক জানিয়েছিলেন, তার স্বামীর অবস্থার অবনতি ঘটেছে। লন্ডনের রিজেন্ট পার্ক জামে মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের পর আনিসুল হকের জানাজা হবে। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তার মরদেহ শনিবার সকালে ঢাকায় পৌঁছবে বলে জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। বাদ আসর আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে ওই দিনই আনিসুল হককে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী আনিসুল হক ২০১৫ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তিনি এফবিসিসিআইর সভাপতি ছিলেন। তার আগে বিজিএমইএ’র সভাপতিও ছিলেন তিনি। সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক মেয়র তার ছোট ভাই। নাতির জন্ম উপলক্ষে গত ২৯ জুলাই যুক্তরাজ্যে যান রুবানা ও আনিসুল হক। সেখানে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আনিসুল হক। ১৩ আগস্ট তাকে লন্ডনের ন্যাশনাল নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ ‘সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস’ শনাক্ত করেন চিকিৎসকরা। এরপর তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটলে তাকে গত ৩১ অক্টোবর আইসিইউ থেকে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু গত মঙ্গলবার অবস্থার অবনতি হলে তাকে পুনরায় আইসিইউতে নেয়া হয়েছিল। তার চার দিনের মাথায় চিরকালের জন্য চলে গেলেন তিনি। টিভি উপস্থাপক সফল ব্যবসায়ী পরিচয়ে চেনামুখ হলেও আনিসুল হকের রাজনীতিতে আসা আকস্মিকভাবেই। কীভাবে তা হলো- তা বর্ণনা করতে গিয়ে আনিসুল হক নিজেই একবার বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘এক ফুঁয়ে আমি নেতা’। মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুলের তৈরি পোশাক ছাড়া বিদ্যুত, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানাও রয়েছে। ডিজিযাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেড এবং নাগরিক টেলিভিশনের মালিকানাও আছে তার ব্যবসায়িক গ্রুপের। আনিসুল হকের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর নানা বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। তার বাবার বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কবিরহাটে। তার বাবা শরীফুল হক ছিলেন আনসারের কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন আনিসুল হক। আশির দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বিকাশের পর্বের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কারখানায় চাকরি নিয়ে এক সময় নিজেই ব্যবসা শুরু করেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে টিভি উপস্থাপক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন আনিসুল হক। তার উপস্থাপনায় ‘আনন্দমেলা’ ও ‘অন্তরালে’ অনুষ্ঠান দুটি জনপ্রিয়তা পায়। তবে পরে টেলিভিশনের পর্দায় মানুষ তাকে বেশি দেখেছিল ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেই। ২০০৫-০৬ সালে বিজিএমইএ’র সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর জরুরী অবস্থার সময় ২০০৮ সালে আসেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হিসেবে। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল মেয়াদে সার্ক চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন আনিসুল হক। এছাড়া বাংলাদেশে বেসরকারী খাতে বিদ্যুত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিআইপিপিএ’রও সভাপতি ছিলেন তিনি। আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাদের মেয়ে মেয়ে তানিশা ফারিয়ামান হকও এই গ্রুপের পরিচালক। আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হক এবং রুবানা হকের মেয়ে ওয়ামিক উমাইরাও গ্রুপটির পরিচালক। মোহাম্মদী গ্রুপের মালিকাধীন দেশ এনার্জি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন নাভিদুল। ওয়ামিক উমাইরা স্নাতক শেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় কাজ করছেন। তানিশা ফারিয়ামান যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের সিমন্স কলেজ থেকে স্নাতক করেছেন। আনিসুল হকের অন্য ভাইদের মধ্যে ইকবাল হক চিকিৎসক, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। হেলাল হক নামে তার আরেক ভাই যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হওয়ার পর বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় ছিলেন আনিসুল হক। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সামনের সড়ক দখলমুক্ত করতে গিয়ে বিক্ষুব্ধ চালকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। পরে ওই সড়ক দখলমুক্ত করে সিটি কর্পোরেশন। গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় বিশেষ রঙের রিক্সা এবং ‘ঢাকা চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সেবা চালু করেন আনিসুল হক। গুলশান এলাকায় অন্যান্য গণপরিবহনের চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় তার সমালোচনা করেন অনেকে। বিমানবন্দর সড়কে যানজট কমাতে মহাখালী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে ইউলুপ করার উদ্যোগ নেন আনিসুল হক। এরইমধ্যে মহাখালী থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১ ইউটার্ন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া ঢাকার খালগুলো উদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন আনিসুল হক। তার নির্দেশে বনানীর ২৭ নম্বরে যুদ্ধাপরাধী মোনায়েম খানের বাড়ি ‘বাগ এ মোনয়েম’র অবৈধ দখলে থাকা অংশ উদ্ধার করে সড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে। মেয়র হিসেবে নগরবাসীর কাছে আরও কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল আনিসুল হকের, সেগুলো বাস্তবায়নের আগেই জীবনাবসান ঘটল তার। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, মেয়র আনিসুল হক একজন সফল ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি প্রয়াতের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। অপরদিকে শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার উন্নয়নে আনিসুল হকের অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনগণের কল্যাণে মেয়র আনিসুল হক অনেক পদক্ষেপ নেন। অসাধারণ কাজের জন্য তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শেখ হাসিনা প্রয়াতের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। এদিকে মেয়র আনিসুলের হকের মৃত্যুতে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের শোক প্রকাশ করেছেন।
×