ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম রোকেয়ার ‘মতিচুর’

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

বেগম রোকেয়ার ‘মতিচুর’

বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) তাঁর সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী চিন্তক এক মহীয়সী নারী। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে; যেখানে তাঁদের পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। এ ছাড়া তাঁরা আরবি ও ফারসি ভাষায় কথা বলতেন ও চর্চা করতেন। রোকেয়ার পরিবারে বাংলা চর্চা প্রায় নিষিদ্ধই ছিল। তিনি তাঁর বড়ভাই ও বড়বোনের কাছে বাংলা শেখেন; পরবর্তীতে বড়বোনের বাড়িতে ইউরোপিয়ান গভর্নেসের কাছে ইংরেজী শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর বড়বোন করিমুন্নেসা ছিলেন একজন মনস্বী রমণী। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘মতিচুর’ (দ্বিতীয় খ-) গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে। এখানে বেগম রোকেয়া লেখেন, ‘আপাজান! আমি শৈশবে তোমার স্নেহের প্রাসাদে বর্ণ পরিচয় পড়তে শিখি। অপর আত্মীয়গণ আমার উদু ও পারসী পড়ায় তত আপত্তি না করিলেও বাঙ্গালা পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। একমাত্র তুমিই আমার বাংলা পড়ার অনুকূলে ছিলে।’ (দ্র. রোকেয়া রচনাবলী, বা.এ, পৃ-৫৭) এই উৎসর্গপত্রের বক্তব্যে দেখা যায়Ñ তিনি সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে থেকে বাংলা শিখেছিলেন। এতে তাঁর মাতৃভাষার প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধই লক্ষ্য করা যায়। বেগম রোকেয়ার প্রথম রচনা ‘পিপাসা’ ১৯৩২ সালে ‘নবপ্রভা’ (চৈত্র ও বৈশাখ-১৩০৮-১৩০৯ সংখ্যা)-এ প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘মতিচুর’ (প্রথমখ-) প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে এবং এর দ্বিতীয়খ- প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। ‘মতিচুর’-এর প্রথমখ-ে ৭টি এবং দ্বিতীয়খ-ে ১০টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। এর মধ্যে দু-একটি প্রবন্ধ বাদে প্রায় সবগুলো প্রবন্ধই নারী জাগরণ মূলক। এরমধ্যে ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’, অর্ধাঙ্গী’, ‘বোরকা’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘নারীসৃষ্টি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। এ সব প্রবন্ধে রোকেয়ার নারীমানসের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে। যে সময়ে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার প্রারম্ভ কাল। বাঙালী সমাজ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিক্ষা-দীক্ষায় ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে উঠছে। কিন্তু এ বাঙালীর একাংশ (মুসলিম সমাজ) তখনও বাংলা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে। এর বিবিধ কারণও রয়েছে। অনেক বাঙালী গোঁড়া মুসলমান মনে করতেন বাংলা ও ইংরেজী শেখা পাপ। তাদের অধিকাংশের পরিবারে উর্দু, আরবী ও ফারসী ভাষার চর্চা ছিল; কথোপকথনও করতেন ঐ ভাষাতেই। মুসলমান বাঙালীদের বাংলা ভাষার প্রতি এমন অবহেলা সেই মধ্যযুগ থেকেই চলে আসছিল; যার চিত্র আমরা কবি আবদুল হাকিমের কবিতাতেও পাই। এমন এক বৈরী পরিবেশে বেগম রোকেয়া লেখনী ধারণ করেছিলেন যে তখন উল্লেখযোগ্য কোনো নারীলেখক তো ছিলেনই না এবং পুরুষলেখকদের মধ্যে পাওয়া যায় শুধু মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবুর রহমান সাহিত্যরতœ, মোজাম্মেল হক, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীÑএ হাতে গোনা কয়েকজনকে। এঁদের লেখায় মুসলমান সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও অসঙ্গতি কথা থাকলেও নারীদের সমস্যার কথা তেমনভাবে আসেনি। বেগম রোকেয়াই একমাত্র লেখক যিনি নারীদের বিভিন্ন ব্যথা-বেদনা ও সমস্যার কথা তাঁর লেখনীতে সুচারুরূপে তুলে ধরেছেন। চারপাশের নারীসমাজের অজ্ঞতা, নির্জীবিতা, নিগৃহীতা অবলোকন করে তিনি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন আর এর প্রতিকার স্বরূপ তিনি শক্ত হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন। ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে ‘স্ত্রী জাতি’ অর্থাৎ নারীর অবনতির বিভিন্ন কারণ তিনি পর্যালোচনা করেছেন। নারীরা সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে সংসারের অনেক কাজ থেকে বিরত থাকে। কেননা পুরুষের বাহুবলের কাছে তারা অনেকটাই দূর্বল; উপরন্তু পুরুষরা তাদের অনেক কাজে সাহায্য-সহযোগিতাও করে থাকে। এতে তারা (নারীরা) ধীরে ধীরে দুর্বল ও অকর্মণ্য হয়ে পড়ছে। দিন দিন যেন তারা পরাশ্রয়ী ভিক্ষুকদের মতো হয়ে পড়ছে; আর এ পরনির্ভশীলতায় তাদের কোনো লজ্জাবোধও হচ্ছে না। লেখিকা বলেছেন, ‘গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া ‘নাকাদড়ি’ পরায়, এ দেশে আমাদের স্বামী আমাদের ‘নোলক’ পরাইয়েছেন। ঐ নোলক হইতেছে ‘স্বামীর অস্তিত্বে’র (সধবার) নিদর্শন।... ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি দাসত্বের নিদর্শন ব্যতীত আর কি হইতে পারে?’ ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে শুধু মুসলিম নারীই নয়, বাঙালী হিন্দু, ইউরোপিয়ান সব নারী জাতির অবনতির মূল কারণ তিনি চিহ্নিত করেছেন এবং তার মূলে যে দাসত্ববোধ রয়েছে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে। ‘অর্ধাঙ্গী’ স্বতন্ত্র প্রবন্ধ হলেও এটি ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধের বর্ধিত রূপ মনে হবে। এখানেও নারী জাতির অবনতির কারণ ও তার প্রতিকারের কথা লেখিকা যুক্তি সঙ্গতভাবে তুলে ধরেছেন। আমাদের সমাজে সমমনা বা সমবয়সী নর-নারীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। সেকালে দেখা যেত পুতুল খেলা বয়সী মেয়েশিশুর সঙ্গে যুবক বা মধ্যবয়সী পুরুষের বিয়ে হচ্ছে। শুধু বয়সেই নয়, পুরুষের তুলনায় তাদের শিক্ষা-দীক্ষাও অনেক পিছিয়ে। তাই দেখা যায়Ñ “প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত।” এতে স্ত্রী স্বামীর ছায়াতুল্য বা সমকক্ষ সঙ্গিনী হতে পারে না। একটি গাড়ির একটি চাকা সাইকেলেরে ও একটি চাকা ট্রাকের হলে গাড়িটি যেভাবে চলবে এদের সংসারও সেভাবেই চলতে থাকবে। নারী জাতির অবনতির স্বরূপ আলোচনা ও তার অধিকার আদায়ের লিখিত প্রবন্ধের জন্য রোকেয়াকে অনেক গোঁড়া পর্দাপ্রিয় নারী কিংবা গোঁড়া মুসলমানদের কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। জনৈক পাঠিকা বেগম রোকেয়ার লেখনীর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এভাবে : ‘তিনি যে রূপ যথেচ্ছাচারিণী রমণীমূর্তি অঙ্কিত করিয়াছেন ও পুরুষ জাতিকে আক্রমণ করিয়াছেন তাহা একজন সম্ভ্রান্তবংশীয় রমণীর জন্য অত্যন্ত নিন্দনীয় হইয়াছ।... স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য গৃহে। স্বামী-সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও তাহাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দতা দেখাই আমাদের প্রধান কর্তব্য।’ (রো.র.পৃ-৬২১) নওশের আলি খান ইউসফজী নামক এক সমালোচকের ভাস্য : ‘‘ ‘আমাদের অবনতি’ পড়িয়া সুখী হইলাম কিন্তু সকল বিষয়ে একমত হইতে পারিলাম না।... অলঙ্কারগুলি যেমন ছিঁড়িয়া ফেলিবেন কিন্তু (মেয়েলি) পোশাকগুলি ছিঁড়িয়া ফেলিয়া বিবসনা না সাজিলে কি প্রকৃত উন্নতি হইতে পারে না।’’ (রো.র.পৃ-৬২২) বেগম রোকেয়া এসব সমালোচনার জবাবও বিভিন্ন প্রবন্ধে দিয়েছেন। ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি লিখেছেন, “কেহ যদি আমার ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে পর্দাবিদ্বেষ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তম রূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন নাই। সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারী জাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধ বন্দিনী থাকেন? অথবা তাঁহারা পর্দানশীল নহেন বলিয়া কি আমি তাঁহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের আলোচনা করিয়াছি।’’ এরূপ সমালোচনার জবাব দিতেই বোধহয় তিনি ‘বোরকা’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। এ প্রবন্ধের শুরুতেই বেগম রোকেয়া পর্দা প্রথার ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখেছেন, ‘‘আমি অনেকবার শুনিয়াছি যে জঘন্য অবরোধ প্রথাই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত ভগ্নিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা প্রায় আমাকে ‘বোরকা’ ছাড়িতে বলেন।... বলি উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে কি বুঝিব যে জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী প্রভুতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে।’’ ‘বোরকা’ প্রবন্ধে দেখা যায়- নারী জাতির উন্নতির মূল অন্তরায় বোরকা নয়। এ কথা স্পষ্ট ভাবে বেগম রোকেয়া বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক ও দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নারীর অবনতির জন্যে শুধু পুরুষ সমাজ নয়, নারী সমাজও দায়ী; দায়ী তাদের সবকিছু মেনে নেওয়া। রোকেয়া যাকে মানসিক দাসত ¡বলেছেন। মূলত পর্দা বলতে তিনি নারীর শরীর আবৃত রাখাকে বুঝিয়েছেন, মনকে আবৃত রাখা নয়; কিন্তু তাদের মনও সবসময় ‘অন্তঃপুরের চারিপ্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ থাকে’। ‘নারীসৃষ্টি’ প্রবন্ধটিতে তিনি একটি পৌরাণিক কাহিনীর অবতারণা করেছেন। নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে ৩৩টি পদার্থের সারাংশ দিয়ে। এর ফলে নারী হয়ে উঠেছে বিচিত্র চরিত্রের অধিকারিণী। তাকে কখনো পুরুষের ভালো লাগে, আবার কখনো সে পুরুষের গলগ্রহ হয়ে থাকে। ‘তদবধি নারী অভিশাপ রূপে পুরুষের গলগ্রহ হইয়া রহিয়াছে।’ নারী যে গোড়া থেকেই পুরুষের গলগ্রহ রূপে তাদের বোঝা হয়ে আছে- এমন কথাই বোঝাতে লেখিকা এ পৌরাণিক কাহিনীটির অবতারণা করেছেন। ‘মতিচুর’-এর শ্রেষ্ঠতর রচনা হলো ‘সুলতানার স্বপ্ন’। এটি ‘ংঁষঃধহধ’ং উৎবধস’ নামে মাদ্রাজ থেকে ‘ওহফরধহ খধফরবং সধমধুরহব’ নামক একটি ইংরেজী পত্রিকায় ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয়। এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে। পরে এর বাংলা অনুবাদ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ শিরোনামে ‘মতিচুর’ (দ্বিতীয়খ-)-এ সংকলিত হয়। এ প্রবন্ধে লেখিকার ঐকান্তিক মানসকল্পনা বা স্বপ্ন অভিনব রূপে প্রকাশ পেয়েছে। এর কাহিনী এমন : সুলতানা স্বপ্নে একটি অদ্ভুত দেশে এসে পৌঁছেছে; যেখানে নারী নয়, পুরুষ গৃহান্তরে থাকে। নারীর বাইরে অবস্থান করে অর্থাৎ অফিস-আদালতের যাবতীয় কার্যক্রম করে থাকে। বেগম রোকেয়ার মানসপটে যে স্বপ্ন আজন্ম লালিত ছিল-তা-ই যেন এ রচনায় পরিস্ফুট হয়েছে। লেখিকা কল্পিত ভগিনী সারার সঙ্গে নানা যুক্তি-তর্কও সৃষ্টি করেছেন। লেখিকা নারীর বন্দিত্বের মূল কারণ পুরুষের বাহুবলের কথা বললে ‘নারীস্থান’-এ সারা বলেছেন, ‘‘কেবল শারীরিক বল বেশি হইলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না। সিংহ কি বলে-বিক্রমে মানবাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে? তাই বলে কি কেশরী মানব জাতির উপর প্রভুত্ব করিবে।’’ এ সারার কথা নয়, লেখিকারই মনের লালিতস্বপ্নের কথা। এখানে নারী বাহুবলে নয় ‘মস্তিষ্ক বলে পুরুষ পরাস্ত’; নারী প্রতিষ্ঠিত সেই স্বপ্নসমাজে পুরুষ ‘মাইনরÑমর্দ্দানাবাসী’। ‘মতিচুর’ (প্রথমখ-) প্রকাশের পর ‘কোহিনুর’ পত্রিকার তিনটি সংখ্যায় (বৈশাখ, আশ্বিন, মাঘ-১৩১৩) এর দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। সে আলোচনার কিয়দংশ: ‘‘ ‘মতিচুর’ সত্যিই মতিচুর; ইহার লিখন ভঙি যেমন বিস্ময়কর, ভাষাও তেমনি মনোহারিণী। ভাষার মধ্যে যে গভীর ভাবরাশি উজ্জ্বল রূপে ফুটিয়া রহিয়াছে, প্রত্যেক পাঠকের নিকট তাহা অন্তত চিন্তার বিষয় হইয়া উঠিয়াছে। (রো.র.পৃ-৫৬২) ‘নবনূর’ পত্রিকায় (ভাদ্র-১৩১২) সংখ্যায় মতিচুর গ্রন্থের সমালোচনা করেছিলেন উক্ত পত্রিকার সম্পাদকদ্বয় মৌলভী আব্দুল করিম ও সৈয়দ এমদাদ আলী। তাঁরা বলেছেন, ‘‘বাইবেলে আছে দূর হইতে একজন লোককে কিম্ভূতকিমাকার বোধ হইতেছিল, যখন সে নিকটে আসিল তখন দেখা গেল সে যে মানুষ; পরিশেষে সে দর্শকের সম্মুখে আসিয়া পড়িলে দেখা গেল সে যে ব্যক্তি তাহারই ভাই। আমরা ‘মতিচুর’ সম্বন্ধেও সেই কথা বলিতে পারি। ‘মতিচুর’-এর প্রবন্ধগুলি যখন ‘নবনূর’-এ প্রকাশিত হয় তখন তাহা পাঠে আমাদের সহিষ্ণুতার বাঁধ টুঁটিয়া গিয়াছিল। সে অবস্থায় তাহাতে যে কিছু ভাল আছে এমন কল্পনাও মনে স্থান দিতে পারি নাই।... তৎপর সংযতভাবে আর একবার বিষয়গুলির আলোচনা করিতে যাইয়া দেখি, লেখিকার সকল কথাই নিরেট সত্য এবং ‘মতিচুর’ প্রকৃত মতিচুর। (রো.র.পৃ-৫৭৫-৫৭৬) ‘মতিচুর’ (দ্বিতীয়খ-)-এর ভূমিকার অনুকূল চন্দ্র রায়ের বক্তব্যের কিয়দংশ : ‘‘লেখিকা শুধু ভাব লইয়া খেলা করেন নাই, প্রায় সকল স্থানেই তিনি যুক্তি দেখাইয়াছেন। অনেক সময় হয়ত তাঁহার মতের সঙ্গে অন্যের মতো মিলিতে নাও পারে কিন্তু তাঁহার রচনায় যে অনেক ভাবিবার বিষয় আছে তাহা অস্বীকার করিলে চলিবে না।... মতিচুর প্রথম খ- কতকগুলি সন্দর্ভের সমবায়। ইহার এই দ্বিতীয় খ-ে দুইটি সন্দর্ভ ছাড়া আর সবগুলিই একটু নতুন ধরনের গল্প।’’ (রো.র.পৃ-৫৭৮-৫৭৯) পরিশেষে বলা যায় বেগম রোকেয়ার গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘মতিচুর’-ই শ্রেষ্ঠতর। যেখানে তিনি নারী জাগরণের কথা বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক ও দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যখন তিনি এ গ্রস্থ রচনা করেন তখন অনেক সমালোচনার মধ্যে পড়লেও তার লেখনিকে কেউ স্তব্ধ করতে পারেনি। নারীসমাজ তথা সমাজ পরিবর্তনে যে এ গ্রন্থখানি বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছিল- তা আমরা এখনও উপলব্ধি করতে পারি। এ গ্রন্থের নারী জাগরণমূলক প্রবন্ধগুলি এখনও প্রাসঙ্গিক এবং ভবিষ্যতেও অনেককাল পর্যন্ত যে তার এ চিন্তা-চেতনা আরও বিস্তৃতি লাভ করবে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
×