ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তাওহিদা খানম তাসমিন

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ সহিংসতা নির্মূল করাই হোক আজকের অঙ্গীকার

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ সহিংসতা নির্মূল করাই হোক আজকের অঙ্গীকার

‘নারীর ওপর যৌন সহিংসতা বন্ধ কর, করতে হবে’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ঘরে-বাইরে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধসহ নারীর জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ২৫ নবেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দিনের সচেতনতামূলক বিশেষ কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও ১৯৯৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিদিনকার ঘটনা। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে পদে পদে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। নারী নির্যাতনের ভয়াবহ দিকটি কত প্রকট হয়ে উঠছে তা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়। প্রতিনিয়ত নারীরা ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, শারীরিক নির্যাতন এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের পাশাপাশি হত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। বাড়ছে ব্যাপক মাত্রায় পারিবারিক নির্যাতন। পারিবারিক নির্যাতন রূপ নিচ্ছে ভয়ঙ্কর সহিংসতায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত ৪ বছর ও চলতি বছরের ১০ মাসে ২৩ হাজার ৩০১ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। দেশে নারী নির্যাতনের আসল চিত্র আরও ভয়াবহ। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৪৭৭৭ জন, ২০১৪ সালে ৪৬৫৪ জন, ২০১৫ সালে ৪৪৩৬, ২০১৬ সালে ৪৮৯৬ জন এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর ৪৫৩৮ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এর হারই সবচেয়ে বেশি। এছাড়া হত্যা, আত্মহত্যা, উত্ত্যক্তকরণ, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, শ্লীলতাহানির মতো নির্যাতনগুলো ভুক্তভোগী নারীর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে করা ‘ভায়োলেন্স এ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১১’ শীর্ষক জরিপ অনুযায়ী, বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোন না কোন সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮২ শতাংশই মানসিক নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার বাস্তব রূপ সম্পর্কে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় উইমেন এ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফসানা ইসলাম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার হার দিন দিন বেড়ে চলেছে; বিশেষত ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা প্রতিদিন চোখে পড়ছে। পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় দ্বারা নির্যাতনের ঘটনাও অহরহ ঘটছে। দেখা যাচ্ছে নারী ঘরে বাইরে কোথাও নিারাপদে নেই। কখনও কখনও নারীর প্রতি সংঘটিত নির্যাতনের দায়ভার নারীকেই নিতে হচ্ছে- দোষারোপ করা হচ্ছে নারীকে। নারীর সুরক্ষায় দেশে যে আইন বিদ্যমান সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। যার ফলে নির্যাতনকারীরা নির্যাতন করতে আর ভয় পায় না। আর ধরা পরলেও আইনের ফাঁকফোকর গলে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের রক্ষণশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। যা নারীর প্রতি নেতিবাচক এবং তাদের ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সমস্যা উত্তরণের অন্যতম উপায় হতে পারে যদি নির্যাতিতা বান্ধব দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য আইনের প্রচলন করা যায়। নীতি নির্ধারণের সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগিয়ে কয়েকটা অপরাধীর শাস্তি বিধান ও কার্যকর হলে চিত্র অনেকটা পাল্টাবে। তাছাড়া সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের যেসব সুবিধা রয়েছে বিশেষত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার। নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধে মন্ত্রণালয়ের হট লাইন সার্ভিস প্রভৃতি সে সম্পর্কে বড় পরিসরে জনগণের মাঝে জানানো প্রয়োজন। একইসঙ্গে সমস্যা উত্তরণে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো প্রথম স্থান, যেখানে নারীকে সম্মান করতে শেখা সম্ভব। অন্যথায়, নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা থামানো যাবে না উপরন্তু এ ধরনের সমস্যা এক রূপ থেকে অন্য রূপে বদলাবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমাজে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক অস্থিরতা আর অশিক্ষা-কুশিক্ষার বলি হচ্ছে নারী। সেইসঙ্গে বিচারহীনতার সংস্কৃতি নারী নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে সমাজে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন বেড়েই চলেছে। তাদের মতে, নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে প্রয়োজন নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে নারী আন্দোলনের কাজকে আরও গতিময় করা, প্রয়োজন সমাজের সব অংশের মানুষের নিজ দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা, নারীর মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, মানবিক সংস্কৃতির চর্চা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, বৈষম্যমূলক আইনের সংশোধনের মাধ্যমে আইনের চোখে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম নারীর প্রতি সহিংসতার পেছনে মূল কারণ হিসেবে দায়ী করেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে। এমন সমাজব্যবস্থায় একজন পুরুষ নারীকে তার সমকক্ষ নয় বরং প্রতিযোগী হিসেবে ভাবে। অন্যদিকে নারীদেরও মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো ঠিকভাবে গড়ে না ওঠায় সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে। তিনি এ ধরনের সহিংসতা বন্ধে সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন বলে জানান। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে পুরুষকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। নারীকে নারী কিংবা প্রতিযোগী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। তাকে মর্যাদা ও মত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে। তবে আইনজীবীরা মনে করেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নিশ্চিত করতে হবে বিভিন্ন আইনের প্রয়োগ। আইন থাকলেও কখনও বা সেই আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না। অনেক সময় আইনের ফাঁক গলে সহজেই নির্যাতনকারীরা বেরিয়ে আসছে। আমাদের দেশে আইন অনেক আছে কিন্তু এ আইনগুলো প্রয়োগে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তাছাড়া অনেক সময় নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে আইনী সহায়তা নিতে চান না। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ফরিদা ইয়াসমীন বলেন, নারী নির্যাতনের পেছনে মূল কারণ মামলার বিচারগুলো দীর্ঘায়িত হওয়া। অর্থাৎ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার ক্ষেত্রে যে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে তার চেয়েও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। এই সময়টাকে দ্রুত করা উচিত। তিনি আরও বলেন, আইন যত কঠোর হয়, আইনের ফাঁকফোকর তত বেড়ে যায়। সে দিকটিও খেয়াল রাখা উচিত। সর্বোপরি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সর্বাগ্রে নারীর প্রতি সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। বদ্ধমূল ধারণা অলীক বিশ^াসের শিকড় উপড়ে ফেলে এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে হবে, যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য সরবরাহ করে তা বিশ্লেষণ এবং বাস্তবায়নের জন্য সক্ষমতা বিকাশে সহায়তা করতে হবে। সব মহলের সচেতনতা ও সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এ অভীষ্ট বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আর তা করা না গেলে সমাজ থেকে শুধু নির্যাতন নয় জেন্ডার বৈষম্যও দূর করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞমহল। আর তাই জেন্ডার বৈষম্যের শিকার নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সব রকম নির্যাতন নির্মূল করাই হোক আজকের অঙ্গীকার।
×