ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ ॥ পরমাণু যুগে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ ॥ পরমাণু যুগে দেশ

পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের ঢালাই কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া পরমাণু বর্জ্য তাদের দেশে নিয়ে যাবে ’২৪ সালে জাতীয় গ্রিডে ২৪০০ মেগা বিদ্যুত যোগ হবে নিরাপত্তার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ স্বপ্নের পরমাণু যুগে প্রবেশ করল আজ। বহুল প্রতীক্ষিত দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পারমাণবিক ও রেডিওলজিক্যাল নিরাপত্তার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে নির্মাণস্থলে যে ভিতের ওপর পরমাণু চুল্লি তৈরি হবে তাতে কংক্রিট ঢালাই শুরু করে নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বাসস জানায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) গাইডলাইন অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী আইএইএর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিটি স্তরে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করছে। যে কোন দুর্যোগে আমাদের এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে কোন প্রকার দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সেটি খেয়াল রেখে এই প্লান্টের ডিজাইন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পারমাণবিক শক্তির নিরাপদ এবং সুরক্ষিত প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং দেশের সর্বপ্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে দেশের জাতীয় পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো শক্তিশালী করার জন্য আমরা বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ প্রণয়ন করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নামে একটি স্বাধীন পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে আইএইএ এবং রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন করেছে’। তিনি বলেন, অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে আমরা আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচী এগিয়ে নিচ্ছি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত সকল ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং প্রটোকলে অনুস্বাক্ষর করেছে। এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল তৈরির জন্য প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কার্যকর উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিবেশ ও মানুষের যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যে কোন পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ তার ব্যবহৃত জ্বালানি বা বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রুশ ফেডারেশন এসব বর্জ্য তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে।’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরিফ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক, রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ সংস্থা রোসাটামের মহাপরিচালক এ্যালেক্সি লেখাচভ এবং আইএইএর পরিচালক দোহি হ্যান অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আনোয়ার হোসেন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা প্রদান করেন এবং প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ শওকত আকবর প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এই বিদ্যুত কেন্দ্র ২০২৪ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের যোগান দেবে। রোসাটামের মাধ্যমে রাশিয়ার আর্থিক, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন ও জেএসসি এ্যাটমস্ট্রোস্পোর্টের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিতে আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান মোঃ মনিরুল আলম ও এ্যাটমস্ট্রোস্পোর্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির এন সাভুসকিন স্বাক্ষর করেন। রোসাটাম নিযুক্ত রাশিয়ার এ্যাটমস্ট্রোস্পোর্টের ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এই প্রকল্প নির্মাণ করবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে দেশের এই সর্ববৃহৎ প্রকল্পের বিনিয়োগ ব্যয় চূড়ান্ত করে। এর আগে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দু’দেশের মধ্যে প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন, সাইট ডেভেলপমেন্ট ও পার্সোনাল ট্রেনিংয়ের জন্য ৫শ’ মিলিয়ন ডলারের রাশিয়ার ঋণ চুক্তি এবং ২০১১ সালে রোসাটামের সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপনে রাশিয়া সব ধরনের সহায়তা দেবে এবং জ্বালানি সরবরাহ করবে ও ব্যবহৃত জ্বালানি ফেরত নেবে। ২৬২ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের দুই ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ২ হাজার ৪শ’ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। যে কোন উন্নয়ন করতে গেলে বিদ্যুত অপরিহার্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুত ছাড়া দেশকে আমরা কখনই উন্নত-সমৃদ্ধ করতে পারব না। এজন্য বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধিতে তার সরকার বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তেল, গ্যাস, কয়লা, সৌর, জলবিদ্যুত, বায়ু যতরকমভাবে বিদ্যুত উৎপাদন করা যায়, তারপর ভারতের থেকে বিদ্যুত ক্রয় করা- সব রকম কাজ কিন্তু আমরা করে যাচ্ছি।’ এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ খরচ বেশি হলেও একবার নির্মাণ হয়ে গেলে অল্প খরচেই বিদ্যুতের চাহিদা মিটবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে যে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে তার অন্তত ১০ ভাগ এই বিদ্যুত কেন্দ্র পূরণ করতে সক্ষম হবে। সবকিছুর মূলে রয়েছে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেজন্যই তাঁর সরকার একের পর এক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে সবধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাই কিন্তু করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে অহেতুক সমালোচকদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এটা নিয়ে যারাই প্রশ্নগুলো তোলেন আমার মনে হয় তাদের ভেতরে একটু আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীর’ উদ্বৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার বক্তব্য অনুযায়ী একশ্রেণীর ‘পরশ্রীকাতর’ লোক দেশে রয়েছেন। তারা সবকিছুতেই একটা নেগেটিভ কিছু খুঁজে বেড়ান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের এই শ্রেণীর লোকেরা লেখাপড়ায় খুব উচ্চমানের এবং তাঁরা সরকার বেসরকারী খাতে টেলিভিশনকে উন্মুক্ত করে দেয়ার সুযোগে তারা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ‘টক শো’ করে বেড়ান। প্রতিনিয়তই কতগুলো প্রশ্ন তারা উত্থাপন করেন। তারা গভীরভাবে দেখেন না যে প্রকৃতপক্ষে আমরা (তাঁর সরকার) কি কি করে যাচ্ছি। তাদের এসব প্রশ্ন যে অবান্তর সেটাও কিন্তু তাদের ভেবে দেখা উচিত। শেখ হাসিনা বলেন, এটার নিরাপত্তার জন্য ইতোমধ্যে আমাদের সেনাবাহিনী কার্যকর ভূমিকা রাখছে। আমাদের পুলিশবাহিনী, আনসার-ভিডিপিসহ আমাদের আইনশৃঙ্খলা সংস্থাকে আমরা সম্পৃক্ত করেছি এবং তাদেরও আমরা বিশেষ প্রশিক্ষণ দেব বিশেষ করে এই পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের নিরাপত্ত দেয়ার জন্য ‘নিরাপত্তা বলয়’ ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা যেমন থকিবে তেমনি ধাপে ধাপে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হবে। নিরাপত্তায় নিযুক্ত সকলেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন এবং সকলের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আমরা করব। সরকারপ্রধান বলেন, আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, একটা কাজ যখন আমরা করতে চাই সেই কাজের ভাল-মন্দ, কি হতে পারে, না হতে পারে সেই সেই বিষয়গুলো চিন্তা-ভাবনা করেই আমরা করি। কাজেই যারা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন এবং ‘টক শো’তে কথা বলে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ক্ষয় করছেন তারা সেটা না করে বরং সেটি সংরক্ষণ করে দেশের ভাল কাজের কোন পরামর্শ থাকলে দেন এবং দেশটা যেন সামনে এগোতে পারে। এ সময় ব্যক্তিজীবনে তার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবা এদেশ স্বাধীন করে গেছেন। লাখো শহীদ রক্ত দিয়েছেন। দীর্ঘ ২৩ বছর এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। এই সংগ্রাম করতে গিয়ে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কত না নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনের অধিকাংশ সময়ই কারাগারে থাকার স্মৃতিচারণ করেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই স্বপ্নের শুরু হয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে। পাকিস্তানীরা আমাদের দেশের টাকা নিয়ে নিজেদের পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত, আর আমাদের উন্নয়ন করবে বলে কেবল ‘মূলা’ ঝুলিয়ে রাখত। তেমনই ছিল এই পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পটি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জমি অধিগ্রহণসহ বেশকিছু কাজ তখন সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে কাজ বন্ধ করে দিয়ে প্রকল্পটি পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এবং তাঁর প্রয়াত স্বামী ড. ওয়াজেদ ও এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর সে কাজ আর এগোয়নি। তিনি বলেন, এরপর দীর্ঘদিন কোন সরকারই এ নিয়ে আর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হাতে নেই। সরকার প্রধান বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পন্ন করতেই তার সরকারের ৫ বছর চলে যায় এবং বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি আবার বন্ধ করে রাখে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আমরা আবার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া এটি বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এজন্য আমি রাশিয়ান ফেডারেশনের সরকার এবং সে দেশের বন্ধুপ্রতিম জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনেও রাশিয়া এবং সে দেশের জনগণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ২০২৩ সাল নাগাদ রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে ১২০০ মেগাওয়াট এবং পরের বছর আরও ১২০০ মেগাওয়াট মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। এ উপলক্ষে এর আগে প্রধানমন্ত্রী একটি স্মারক ডাকটিকেট ও একটি উদ্বোধনীর খাম অবমুক্ত করেন। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মুহম্মদ শফিউল হক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, বাংলাদেশে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ইগনেটভ, রাশিয়ার স্টেট এটমিক এনার্জি কর্পোরেশন-রোসাটামের মহাপরিচালক এলেসি লিখাচেভ, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চীফ ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এবং প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ শওকত আকবর এবং বাংলাদেশ ও রাশিয়ার প্রকল্পের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এই বিদ্যুত কেন্দ্র ২০২৪ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের যোগান দেবে। রোসাটামের মাধ্যমে রাশিয়ার আর্থিক, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও জেএসসি এ্যাটমস্ট্রোক্সপোর্টের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিতে আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান মোঃ মনিরুল আলম ও এ্যাটমস্ট্রোক্সপোর্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির এন সাভুসকিন স্বাক্ষর করেন। রোসাটাম নিযুক্ত রাশিয়ার এ্যাটমস্ট্রোক্সপোর্টের ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এই প্রকল্প নির্মাণ করবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে দেশের এই সর্ববৃহৎ প্রকল্পের বিনিয়োগ ব্যয় চূড়ান্ত করে। এর আগে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দু’দেশের মধ্যে প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন, সাইট ডেভেলপমেন্ট ও পার্সোনাল ট্রেনিংয়ের জন্য ৫শ’ মিলিয়ন ডলারের রাশিয়ার ঋণ চুক্তি এবং ২০১১ সালে রোসাটামের সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপনে রাশিয়া সব ধরনের সহায়তা দেবে এবং জ্বালানি সরবরাহ করবে ও ব্যবহৃত জ্বালানি ফেরত নেবে। ২৬২ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের দুই ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ২ হাজার ৪শ’ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তৌহিদ আক্তার পান্না, ঈশ্বরদী থেকে জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ এবং বাঙালী জাতি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মানীত জাতি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম কংক্রিট ঢালাই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, আজকের দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। মূল অবকাঠামো নির্মাণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ প্রবেশ করল পরমাণু বিশ্বে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য অনেক গৌরবের এবং আনন্দের। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোন ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এই স্বপ্নের শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে। জমি অধিগ্রহণসহ বেশকিছু কাজ তখন সম্পন্ন হয়েছিল কিন্তু পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে কাজ বন্ধ করে দিয়ে প্রকল্পটি পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর সে কাজ আর এগোয়নি। এর পর দীর্ঘদিন কোন সরকারই এ নিয়ে আর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেই। পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন একটি জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পরমাণু নিরাপত্তাসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি এবং আইন কানুন অনুসরণ করে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে এসে আমরা জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আমরা সে সময় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএর সহযোগিতা চাই। তাদের সহায়তায় আমরা একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করেছিলাম। আজ সেই স্বপ্নের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।
×