ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উনি আমারও জাতির পিতা

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

উনি আমারও জাতির পিতা

প্রজন্ম নিয়ে আমরা প্রায়ই কথা বলি। এই প্রজন্ম শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি বা সমাজ ভাবনায় প্রবাসের এই প্রজন্মটি খুব বেশি জায়গা পেয়েছে বলে কখনই মনে হয়নি। অথচ বিশ্বের প্রায় প্রতিটা দেশেই চর্চা হয় বাংলাদেশ, বাঙালীপনা, দলীয় রাজনীতি, খাদ্য ও শেকড়বন্ধননীতি। সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করার সময় বিশ্বের তথা বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাতকার নিয়েছি। শোনার চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ নিয়ে তাদের ভাবনার কথা, পরামর্শ। সেই অর্থে প্রজন্মের কথা কখনই শোনা হয়নি। আমার ছোট ছেলে ওমিদ খান, বয়স বারো। সুইডেনের একটি প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। সুইডিশ তার প্রথম ভাষা হলেও অনর্গল ইংরেজীতে কথা বলতে পারে। বাসায় অবশ্য সুইডিশ ও বাংলা দুটোই চলে। বেশ কিছুদিন ধরে প্রজন্মের বিষয়টি আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কম্পিউটার যুগের ওমিদের দিকে তাকালে জেনেটিক কিছু বিষয় ছাড়া তার চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ বা জ্ঞানচর্চার পরিধিগুলোর সঙ্গে আমার ছেলেবেলার তেমন একটা মিল খুঁজে পাই না। সিদ্ধান্ত নেই প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ওমিদের একটা সাক্ষাতকার নেয়ার। সে জানে তার বাবা শুধু কম্পিউটার প্রকৌশলীই নয়, সাংবাদিকও। সাক্ষাতকারের প্রস্তাব দিতেই কোন ধরনের জড়তা ছাড়াই রাজি হয়ে যায়। তবে সম্মানীর বিনিময়ে তা হতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দেয়। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করতেই উত্তরে সে আমার সাক্ষাতকারের গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। অবাক হলেও তখন রাজি না হয়ে কোন উপায় থাকে না। তার যৌক্তিক ভাবনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগে। মুগ্ধ হয়ে ভাবি, গুরুত্ব বিবেচনায় পিতা-পুত্রের সম্পর্ককেও সে কত সহজে এবং নৈতিক জায়গা থেকে আলাদা করতে পেরেছে। ওমিদের শিশুসুলভ হাজারও ব্যস্ততার কারণে সে আমাকে সময় দিতে পারছিল না। অনেক চেষ্টায় শেষমেশ তার সাক্ষাতকারটি নিতে সক্ষম হয়েছি। সাব্বির : আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করছি। ঠিক আছে? ওমিদ : ঠিক আছে, করতে পার। সাক্ষাতকারে স্যার বলাই উচিত। সাব্বির : আপনি নিজেকে বাঙালী ভাবেন, নাকি সুইডিশ? ওমিদ : আমি অর্ধেকটা বাঙালী, আর অর্ধেকটা সুইডিশ। আমার দেহে তোমার আর আম্মুর রক্ত, যা বাংলাদেশী। আর আমার জন্ম, স্কুল, বন্ধুবান্ধব, খাদ্য, বাসস্থান, পাসপোর্টÑ এসবই সুইডিশ। বলতে পার রক্তে আমি বাংলাদেশী আর জন্মগতভাবে সুইডিশ। দুটোই সত্যি। সাব্বির : এভাবে ভাবতে অসুবিধা হয় না আপনার? ওমিদ : প্রথমে কিছুটা হতো। বুঝতাম না। এখন বুঝি। আমার স্কুলেও অনেক বন্ধু আছে, যারা আমার মতোই অর্ধেক-অর্ধেক (মৃদু হেসে)। সাব্বির : আপনি কি কোন আদর্শ বা মতবাদের প্রতি অনুগত? ওমিদ : মতবাদ মানে কি? শব্দটা বুঝি না। সাব্বির : এই যেমন ধরুন, আপনি আপনার বাবা-মায়ের কোন বিষয়কে অনুসরণ বা অনুকরণ করেন। এটাকে আদর্শ বলা যেতে পারে। আবার ধরুন, আপনি নিজের থেকেই কোন কিছুকে বিশ্বাস করে অনুসরণ করেন, যেমন সৃষ্টিকর্তা। অনেকে সৃষ্টিকর্তাকে অবিশ্বাসও করেন। এগুলোকে মতবাদ বলা যেতে পারে। আপনার ক্ষেত্রে কি এমন কিছু আছে? ওমিদ : তুমি যে কম্পিউটরে কাজ করো এটা আমার ভাল লাগে। এ জন্য আমিও প্রতিদিন চেষ্টা করি এটাকে অনুসরণ করতে এবং কম্পিউটারে গেম খেলতে (চেহারায় দুষ্টুমির হাসি)। তবে গডের ব্যাপারটা স্কুলে পড়ছি। সব ধর্মই আমাদের পড়ায়। অনেক কিছুই বুঝি না। সব ধর্মই মানুষকে ভালবাসার কথা বলে। এটা আমার ভাল লাগে। আমিও সব মানুষকে ভালবাসি। শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পকে অপছন্দ করি। তিনি একজন বর্ণবাদী। তিনি বিদেশীদের আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে স্কুলে আলোচনায় শুনেছি, ইন্টারনেটেও পড়েছি। এটা ভাল নয়। আমরা সবাই এই পৃথিবীর মানুষ। আমাদের যেখানে ইচ্ছা সেখানেই থাকব। তিনি ঠিক করে দেয়ার কে? সাব্বির : ‘বর্ণবাদ’ কি? ওমিদ : আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর বাবা-মা আফ্রিকান। কালো বলে কেউ তাকে আলাদাভাবে দেখলে আমি কষ্ট পাই। আমি তাকে অনেক ভালবাসি। সুইডেনে সাদাকালো সবাই সমান, সবার সমান অধিকার। ক্লাসে পড়েছি, এগুলোকে যারা না মানে তারা বর্ণবাদী। সে জন্য ট্রাম্পকে বর্ণবাদী মনে হয়। তিনি বিদেশীদের পছন্দ করেন না। সাব্বির : আপনি রাজনীতি পছন্দ করেন? ওমিদ : বড়রা রাজনীতি করে। আমি তো এখনও অনেক ছোট। বেশি বুঝি না। তবে বড় হয়েও আমি রাজনীতিবিদ হতে চাই না। ‘রেইসিং কার’ আমার পছন্দ। বড় হয়ে আমি ঋড়ৎসঁষধ ঙহব প্রতিযোগী হতে চাই। সাব্বির : সুইডেনের কোন্ রাজনৈতিক দলকে আপনি পছন্দ করেন? ওমিদ : গ্রীন পার্টি নামের একটা দল আমাদের স্কুলে এসেছিল একদিন। আবহাওয়া ও পরিবেশ নিয়ে আমাদের ক্লাস নিয়েছিল। অনেক কথা সেদিন বলেছিল, যা শুনে আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমাদের কারণে নাকি পৃথিবীর অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সুইডেনে অনেক বন আর গাছ আছে। সেটা আমাদের জন্য অনেক ভাল। পানির অপচয় করতে বারণ করেছিল। রাস্তাঘাটে প্লাস্টিক বা কোন আবর্জনা ফেললে পরিবেশের ক্ষতি হয়, বলেছিল। তাদের সব কথাই আমার ভাল লেগেছিল। ভেবেছি বড় হয়ে আমি তাদের ভোট দেব। সাব্বির : বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলুন। ওমিদ : বাংলাদেশের জাতির পিতার কথা শুনেছি কিছুদিন আগে। টিচার ইন্টারনেটে দেখিয়েছিলেন যে, ইউনেস্কোর তালিকায় ওনার নাম এসেছে। শুনে অনেক আনন্দ হয়েছিল। তোমার ফেসবুক কভার ফটোতে একটা ছবি দেখিয়ে বলেছিলে যে, উনি বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিব। উনি তো তাহলে আমারও জাতির পিতা! সাব্বির : বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ নিয়ে কিছু বলুন। ওমিদ : যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম তখন রাস্তাঘাট অপরিষ্কার মনে হয়েছিল। অনেক মানুষ আর গাড়ি দেখেছিলাম রাস্তায়, উঁচু উঁচু দালান, প্রচ- গরম। কোন কিছুই সুইডেনের মতো মনে হয়নি। মানুষকে যেখানে-সেখানে থু থু ফেলতে দেখেছি, আবর্জনাও দেখেছি রাস্তায়। আমার মনে হয় এসব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভাল নয়। সবার উচিত দেশকে ভালবাসা। সাব্বির : রান্না করতে পারেন? প্রিয় খাবার কি? ওমিদ : হুম, পাস্তা রান্না আর ডিম ফ্রাই করতে পারি। স্যান্ডউইচও বানাতে পারি। প্রিয় খাবার চকলেট। স্কুলে রান্না শেখায়। খাবারের চেয়ে কম্পিউটর গেম বেশি ভাল লাগে (হেসে)। সাব্বির : দুটো শব্দ বলছি, ‘যুদ্ধাপরাধ’ ও ‘মৃত্যুদ-’। আপনার প্রতিক্রিয়া কি? ওমিদ : শব্দ দুটো বুঝিনি। আমি কি গুগলের সাহায্য নিতে পারি উত্তরটা দিতে? সাব্বির : জি, নিশ্চয়ই স্যার! ওমিদ : ধন্যবাদ। (বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে) হুম, বুঝেছি। আমার যে প্রিয় বন্ধু তার দেশেও যুদ্ধ চলছে বলে শুনেছি। যুদ্ধে অনেক মানুষ মারা যায়। অনেক শিশু না খেয়ে মরে। এগুলো খুব অমানবিক। যাদের কারণে এগুলো হয় তারা যুদ্ধাপরাধী। তাদের অবশ্যই সাজা হওয়া উচিত। তবে আমি কারও মৃত্যুদ- চাই না। যুদ্ধাপরাধীদের সারাজীবন বন্দী করে রাখা উচিত। এসব নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগছে না। অন্যকিছু জিজ্ঞেস করবে? সাব্বির : নাহ্্, ঠিক আছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে সময় দেয়ার জন্য। ভাল থাকবেন। ওমিদ : তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ। সম্মানীটা দেবে তো! শেষের প্রশ্নে ওমিদের মানসিক অস্থিরতা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। শিশু কোমল মনে যুদ্ধ বিষয়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি তা বড়দের মাঝে দেখিনি। অল্প কিছু আলাপচারিতায় এ প্রজন্মের প্রতিনিধির যে স্পষ্ট চিত্র আমি দেখেছি তা আমাকে অভিভূত করেছে। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় দূর দেশের ওমিদের মুখ থেকে উচ্চারণ হতে শুনলাম জাতির পিতার কথা, বাংলাদেশের কথা, দেশকে ভালবাসার কথা, পরিবেশ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা, বর্ণবাদ আর যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থানের কথা। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাক্ষাতকারে গভীর-তত্ত্বীয় এবং ঘোর প্যাঁচানো অনেক কথা ইতোপূর্বে শুনেছি। প্রজন্মের প্রতিনিধি ওমিদ খান তার বক্তব্যে এ দুইয়ের মাঝে যেন স্পষ্ট মোটা একটা রেখা টেনে দিয়েছে। ওমিদের সোজাসাপ্টা জবাবগুলো বুঝিয়ে দিয়েছে ‘সে পরিবর্তিত নতুন যুগের এক বিশ্ব নাগরিক’। সাদা আর কালোর মাঝে ধূসর এলাকা খোঁজার যৌক্তিকতা তার কাছে অর্থহীন। লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক [email protected]
×