ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী

পোপের সফরের আত্মিক ও সামাজিক গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

পোপের সফরের আত্মিক ও সামাজিক গুরুত্ব

পৃথিবীতে খ্রিস্টীয় চার্চে (বাংলা ‘মণ্ডলী’) তিনটি সম্প্রদায় : রোমান ক্যাথলিক চার্চ, অর্থডক্স চার্চ ও প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত চার্চ। রোমান ক্যাথলিক চার্চ হলো সর্ববৃহৎ। বর্তমানে একশত কোটিরও বেশি খ্রিস্টভক্ত এ চার্চ বা ম-লীর অন্তর্ভুক্ত। গোটা পৃথিবীতে যেমন, তেমনি বাংলাদেশে রোমান ক্যাথলিক ম-লীর অন্তর্ভুক্ত জনসংখ্যা খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এদেশে বর্তমানে প্রায় ১২-১৩ লাখ খ্রীস্টিয়ানের মধ্যে রোমান ক্যাথলিকদের সংখ্যা আনুমানিক পাঁচ লাখ। বাকিরা প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ব্যাপ্টিস্ট, এ্যাংলিকান, লুথারান, প্রেসবিটারিয়ান, মেথডিস্ট ইত্যাদি ছোট-বড় চার্চের সদস্য। দীর্ঘ পাঁচশত বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ঐতিহ্যবাহী এ দেশের সর্ববৃহৎ খ্রিস্টীয় সংগঠন রোমান ক্যাথলিক ম-লীর সঙ্গে আমরা সবাই আনন্দিত যে, পৃথিবীর সমস্ত ক্যাথলিক মন্ডলীর সর্বপ্রধান ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরু পুণ্যপিতা ২৬৬তম পোপ ফ্রান্সিস্ বাংলাদেশে দু’দিনের জন্য ৩০ নবেম্বর আগমন করেছেন। তাঁর এ সফরের আত্মিক ও সামাজিক গুরুত্ব অনেক। হাজার হাজার রোমান ক্যাথলিক তাঁর দর্শন লাভ ও পৌরহিত্যে চার্চের সর্বপ্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান খ্রীস্টযাগ গ্রহণের জন্য স্বাভাবিকভাবেই অধীর আগ্রহে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছেন। আজ শুক্রবার (১ ডিসেম্বর, ২০১৭) ঐতিহ্যবাহী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে সকাল ১০ ঘটিকায়। এ অনুষ্ঠান ছাড়াও পোপ কতগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন, যেখানে সরকারী, বেসরকারী নেতৃবর্গ, বাংলাদেশের শ্রদ্ধেয় কার্ডিনালসহ ক্যাথলিক নেতৃবৃন্দ, অন্যান্য ম-লীর নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন ধর্মের নেতৃবর্গ উপস্থিত থাকবেন। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার সঙ্গেও পোপ কথাবার্তা বলবেন। ইতালীয় বংশোদ্ভূত একজন আর্জেন্টীয় পোপ ফ্রান্সিস্ ১৯ মার্চ, ২০১৩ সালে তাঁর পোপীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম হোর্হে মারিও বেরগোগ্লিও। পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সাধু ফ্রান্সিস্ অব্ আসিসির সম্মানার্থে ‘ফ্রান্সিস্’ নাম গ্রহণ করেন। বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার পরও সাধু ফ্রান্সিস্ সব কিছু ত্যাগ করে বেছে নিয়েছিলেন দরিদ্রতার জীবন। বেরগোগ্লিওই প্রথম পোপ, যিনি তাঁর উত্তরসূরিদের কোন নাম গ্রহণ না করে ‘ফ্রান্সিস্’ নাম গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাধু ফ্রান্সিস্ খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে আভিজাত্য, অহঙ্কার, গর্ব ও মা-লিক ক্ষমতার পরিবর্তে দরিদ্রতার ধারণা নিয়ে এসেছেন।’ নতুন নাম গ্রহণের পর তিনি বলেন, ‘ম-লী দরিদ্র এবং দরিদ্রদের জন্য।’ এ থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি দরিদ্রদের পক্ষে কাজ করতে এবং ম-লীতে পরিবর্তন আনার কাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বর্তমানে পোপ ফ্রান্সিসের বড় একটা উৎকণ্ঠার বিষয় হলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা। সে কারণে তিনি বাংলাদেশে আসার পূর্বে মিয়ানমার সফর করেছেন। তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ও সমাজের মাঝে শান্তি এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়ার জন্য বিশ্বের ধর্মীয় নেতাদের প্রতি তিনি অবিরত আহ্বান জানাচ্ছেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আধুনিক পোপগণ মানবীয় মূল্যবোধ ও তার চর্চার ওপরে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। ধর্ম, জাতি, গোত্র, বর্ণভেদে সকল মানুষের মানবীয় মর্যাদা তাদের কাছে বড় বিষয়। আমার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮১’র ফেব্রুয়ারি মাসে তদানীন্তন পোপ দি¦তীয় জন পলের সঙ্গে দেখা করার। সেদিন আমার সঙ্গে পৃথিবীর ৪০টি দেশের প্রায় ষাটজন ছিলেন ভ্যাটিকানে তাঁর প্রাসাদে তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য। তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন ১৯৮৬ সালে। পোপ ফ্রান্সিস্ ঠিক তাঁর মতোই অত্যন্ত জনপ্রিয় ও মানবমুখী। পবিত্র বাইবেলের কথাÑ‘যাহারা আনন্দ করে তাহাদের সহিত আনন্দ কর, যাহারা রোদন করে তাহাদের সহিত রোদন কর’ (রোমীয় পত্র ১২:১৫)। বর্তমান পোপগণ মানবাধিকারবঞ্চিত দুর্বল সকল মানুষের মানবাধিকার রক্ষা ও মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তৈরির কাজকে এবং মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের ওপরে গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের চরম দুর্গতিতে পোপ ফ্রান্সিসের প্রাণ কাঁদে বলেই তিনি মিয়ানমার ও বাংলাদেশে পরপর ভ্রমণ করছেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিসের এই দেশে আগমন ও এদেশের সকল মানুষের জন্য তাঁর নিঃস্বার্থ প্রেম, শুভাশীষ ও স্রষ্টার কাছে তাঁর বিনীত প্রার্থনা আমাদের সবাইকে আনন্দিত করছে। ‘চড়ঢ়ব’ শব্দের সমার্থক শব্দ হলো চড়হঃরভবী ও চড়হঃরভভ, যার অর্থ ‘সেতু’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জনগোষ্ঠীর কাছে পোপের সফর ও তাঁর শান্তির বারতা মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির সেতু রচনা করে চলেছে। বাংলাদেশে তাঁর আগমন রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের একটা পথনির্দেশনা পাবে বলে বিশ্বাস করি। সেইসঙ্গে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি এবং আন্তঃম-লিক (ওহঃবৎ ঈযঁৎপয) সম্পর্ক ও সহভাগিতার পথ প্রশস্ত হবে বলেও আশা করি। মহামান্য পোপের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি যেন তিনি স্রষ্টার গৌরব ও মানুষের কল্যাণে আরও অনেক কাজ করতে পারেন। লেখক : খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক
×