ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ দুর্যোগ-দুর্ভোগ বালা-মুসিবত

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ দুর্যোগ-দুর্ভোগ বালা-মুসিবত

সৌরমণ্ডলের সীমাহীন অবস্থানের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে অবস্থিত পৃথিবী নামক এই মৃত্তিকা গ্রহে যেদিন আদি মানব-মানবী সেরা সৃষ্টির সম্মান নিয়ে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নির্দেশে বসত স্থাপন করেছে সেদিন থেকেই সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, দুর্যোগ-দুর্ভোগ, বালা-মুসিবত, প্রেম-প্রীতি, আমোদ-আহ্লাদ, স্নেহ-আদর, উত্থান-পতন, ভাঙ্গা-গড়া প্রভৃতি নানা বৈশিষ্ট্যে ও অনুভবে অঙ্কুরিত এবং বিকশিত হয়েছে। পৃথিবীতে প্রথম মৃত্যু সংঘটিত হয়েছিল আদম হাওয়ার দুই পুত্রের মধ্যে নারী-প্রেমঘটিত সংঘাতে। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম ‘আলায়হিস্ সালাম ও আদি মাতা হযরত হাওয়া আলায়হাস্ সালামকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু সৃষ্টি করেন আসমানী বাগিচায় অর্থাৎ জান্নাতে। হযরত আদম ‘আলায়হিস্ সালামকে সৃষ্টি করার কথা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ফেরেশতাদের নিকট বললে তারা বিনয়াবনত হয়ে বলে : আপনি কি সেখানে এমন কিছু সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার তসবিহ-তাহ্লীল করছি, আপনার প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি (আল্লাহ) বললেন : ইন্নি আ’লামু মালা তা’লামুন- আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। (সূরা বাকারা : আয়াত ৩০-৩১)। আল্লাহ জাল্লা শানুহু হযরত আদম ‘আলায়হিস্ সালামকে সেই জান্নাতে সৃষ্টি করলেন, তাঁকে তাবত্ জ্ঞান শিক্ষা দিলেন, তারপর আদমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য ফেরেশতাদের জ্ঞানের পরীক্ষা নিলেন। ফেরেশতারা আদমের জ্ঞানের কাছে পরাভূত হলো। তখন আল্লাহ্ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন আদমকে অবনত মস্তকে সম্মান জানাতে। সব ফেরেশতাই আল্লাহর নির্দেশে হযরত আদম ‘আলায়হিস্ সালামকে অবনত মস্তকে সম্মান জানাল। কিন্তু ইব্লিস আল্লাহর হুকুম পালন করল না। সে অহঙ্কার প্রকাশ করল। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : সে (ইব্িলস) বলল, আমি তার (আদম) থেকে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির কাদা থেকে। (সূরা সাদ : আয়াত ৭৬)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত আদম ‘আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া ‘আলায়হাস্ সালামকে জান্নাতে বসবাস করতে অনুমতি দিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : এবং আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। ... কিন্তু এই গাছটির কাছ ঘেঁষাও হয়ো না। যদি হও তাহলে তোমরা জালিম বলে গণ্য হবে। (সূরা বাকারা : আয়াত ৩৫)। কিন্তু বিতাড়িত শয়তান ইবলিস তাঁদের দ্বারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করানোর জন্য সঙ্গোপনে তৎপর হলো। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইব্লিস সম্পর্কে তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে ইরশাদ করেন : অতঃপর আমি বললাম : হে আদম! নিশ্চয়ই এ (ইব্লিস) তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদের জান্নাত হতে বের করতে না পারে। পারলে তোমরা দুঃখ-কষ্ট পাবে। (সূরা তহা : আয়াত ১১৭)। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। ইব্লিস শয়তানের প্ররোচনায় ভুলক্রমে তারা নিষিদ্ধ ওই গাছের ফল খেয়ে জান্নাতী সুখের নিবাস থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করতে বাধ্য হলো। তাদের জীবনে নেমে এলো দুঃখ-কষ্ট আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু আগেই যা সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : কিন্তু শয়তান তা থেকে তাদের পদস্খলন ঘটাল এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদের বের করল। আমি বললাম, তোমরা একে অপরের শত্রুরূপে নেমে যাও, পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল। (সূরা বাকারা : আয়াত ৩৬)। মানব জীবনে সেই যে দুঃখ-কষ্টের সূত্রপাত হলো তা যুগে যুগে নানাভাবে, নানা আকারে, নানা কারণে নানা অবস্থায় চলে আসছে। আমরা যাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলি তাতে লক্ষ্য করা যায় যে, তা আসে মানুষেরই কৃতকর্মের ফলে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা না করার কারণে, এক কথায় পাপ করার কারণে, সত্য-সুন্দরকে অগ্রাহ্য ও প্রত্যাখ্যান করার কারণে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু বিশাল বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন সুশৃঙ্খল পরিমিতির ওপর স্থিতি করে, যার ফলে বিশ্বজগতের তাবত কিছু আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মে যার যার ভারসাম্য নিয়ে চলমান বা ঘূর্ণায়মান রয়েছে কিংবা যথাযথ নির্ধারিত স্থানে স্থিত রয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তিনি (আল্লাহ) সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে। (সূরা ফুরকান : আয়াত ২), সূর্য ও চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে, তৃণলতা ও বৃক্ষাদি তাঁরই সিজ্দায় রত রয়েছে, তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন মানদ-, যাতে তোমরা সীমা লঙ্ঘন না কর মানদ-ে। (সূরা আর-রহমান : আয়াত ৬-৮), যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা করেছেন ও আকাশকে করেছেন ছাদ এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণের দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন। সুতরাং তোমরা জেনেশুনে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় কর না। (সূরা বাকারা : আয়াত ২২), তিনিই ভূতলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক প্রকারের ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়। তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সমাজের জন্য। সূরা রা’দ : আয়াত ৩)। যে ‘কাদর’ বা পরিমিতি তথা ভারসাম্যের ওপর আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু পৃথিবীটাকে স্থিতি দান করেছেন সেই স্থিতির ভারসাম্যকে মানুষ নানা প্রক্রিয়ায় বিনষ্ট করে চলেছে, যার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসছে নানা রূপে, নানা আদলে। আমরা পাহাড়-পর্বত ভেঙ্গে ফেলছি প্রকৃতির নিয়মকে লঙ্ঘন করে। অথচ আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু ইরশাদ করেন : আর পৃথিবীকে আমি বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে (পৃথিবীতে) প্রত্যেক বস্তু উদ্গত করেছি সুপরিমিতভাবে। (সূরা হিজর : আয়াত ১৯), এবং তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয় এবং স্থাপন করেছি নদ-নদী ও পথ, যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পার। (সূরা নহল : আয়াত ১৫), তিনি স্থাপন করেছেন অটল পর্বতমালা ভূপৃষ্ঠে এবং তাতে রেখেছেন কল্যাণ। (সূরা হা-মীম আস্ সাজ্দা, আয়াত ১০)। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×