ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এখান থেকে সরবরাহ করা হতো দেশের বিভিন্ন স্থানে

পদ্মার আলাতুলি চরের বাথান ছিল জঙ্গীদের বোমার কারখানা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩০ নভেম্বর ২০১৭

পদ্মার আলাতুলি চরের বাথান ছিল জঙ্গীদের বোমার কারখানা

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ পাখিপ্রেমীদের ছদ্মাবরণে গত ছয় মাস ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুর্গম পদ্মার মধ্যচর আলাতুলিতে আনাগোনা ছিল জেএমবি সদস্যদের। এনজিওর পাশাপাশি পাখি শিকার, পাখির ছবি তোলা ও বেড়ানোর কথা বলে মাঝেমধ্যেই আলাতুলিতে আসত অপরিচিতরা। মুখে পাখিপ্রেমী বললেও ভেতরে তাদের মিশন ছিল নির্জন ও অপেক্ষাকৃত জনবিচ্ছিন্ন চরের ওই খুপড়িঘরে জঙ্গী ডেরা গড়ে তোলা। তারা লক্ষ্য অনুযায়ী আস্তানা গড়েও তুলে সেখানে। সেখান থেকেই ছক ছিল রাজশাহী অঞ্চলে বড় ধরনের নাশকতার। তবে শেষ পর্যন্ত র‌্যাবের শক্তিশালী গোয়েন্দা তথ্যের কারণে ভেস্তে যায় সব পরিকল্পনা। নির্জন এ ডেরায় জেএমবির প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও বোমা তৈরির কারখানা হিসেবেও গড়ে তুলছিল তারা। চরের এ বাথানবাড়িতে জঙ্গীদের নিয়ে যেতেন রাশিকুলের ১৫ বছর বয়সের ছেলে। দুই-এক রাত তারা রাশিকুলের বাথানবাড়িতেও থাকত বলে জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আলাতুলি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মেজবাউল হক। তিনি জানান, দুর্গম ওই চরে কৃষি খামার করার কথা বলে রাশিকুলের বাথানবাড়ি ভাড়া নেয় বলে ১৫ দিন আগে দুইজন জানিয়েছিল। তারাও নিজেদের এনজিও কর্মী বলে পরিচয় দেয়। চার দিন আগে তারা ওই বাড়িতে এসে থেকে যায়। তবে তাদের আচরণ সন্দেহজনক ছিল। তারা সেখানে কি ধরনের কৃষিখামার করতে চান তা তারা জানায়নি বলে জানান ইউপি মেম্বার মেজবাউল। জানা গেছে, আলাতুলি চরের তিনভাগের একভাগ রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মধ্যে। বাকিটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ উপজেলায়। ওই চরে মাষকালাইয়ের আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। রাশিকুলের বাথানবাড়িটি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা এলাকার মধ্যে। তবে এর দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কোন বাড়িঘর নেই। সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে ভারতের লালগোলা সীমান্ত। র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ ও বোমা তৈরির জন্য দুর্গম চর আলাতুলিতে আস্তানাটি গড়ে তোলা হয়েছিল ছয় মাস আগে। যেটি ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর আস্তানা। এ আস্তানায় বোমা তৈরি ও বিস্ফোরণ ঘটনার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এ ছাড়াও সেখানে তৈরি করা বোমা বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করত জঙ্গীরা। তিনি বলেন, ঢাকার মিরপুরের আস্তানায় অভিযান পরিচালনার সময় জঙ্গী আব্দুল্লাহ পরিবার ও সহযোগীসহ নিহত হন। সেখান থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকজন জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা জানিয়েছিল পদ্মার চরাঞ্চলে তাদের আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে প্রশিক্ষণ ও বোমা তৈরি করা হয়ে থাকে। তাদের দেয়া তথ্যে এ অঞ্চলের সম্ভাব্য কয়েকটি চরে র‌্যাব কিছুদিন ধরে নজরদারি করে। এর মাধ্যমে স্থানীয়দের সহযোগিতায় আলাতুলির দুর্গম এই জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায় বলে জানান তিনি। মুফতি মাহমুদ বলেন, অভিযানের শুরু থেকেই তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় দফায় দফায়। তবে তারা র‌্যাবের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ওই ঘর থেকে দুইটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। ভোর ৫টার দিকে তারা দ্বিতীয় দফায় ৩ থেকে চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের মধ্যে বাঁশ আর টিনের তৈরি ওই ঘরে আগুন ধরে যায়। জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের আগে বাথানবাড়ির মালিক রাশিকুলের স্ত্রী নাজমা বেগম, নাজমার বাবা খোরশেদ আলম ও মা মিনারা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোদাগাড়ী উপজেলার সাব্দিপুর সরকারপাড়া থেকে আটক করে র‌্যাব। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজশাহী অঞ্চলে এ পর্যন্ত বড় তিনটি জঙ্গী অভিযানের ঘটনা ঘটল। সবকটি ঘটনায় ঘটেছে প্রায় জনমানবহীন দুর্গম এলাকায়। সর্বশেষ চর আলাতুলি মধ্যচরের অবস্থানও জনমানবহীন নির্জন। সহজে সেখানে কেউ যায় না। এই চরে শুধু একটি বাড়িই ছিল। দুর্গম ও নির্জন বাথানবাড়ি হওয়ায় সেটিকেই আস্তানা হিসেবে বেছে নেয় জঙ্গীরা। স্থানীয় আজিজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি জানান, জঙ্গীরা যেখানে আস্তানাটি গড়ে তোলে সেখানে সহজে চাইলেও যাওয়া যাবে না। কারণ চরে যেতে হলে গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের ডাকবাংলোর কাছ থেকে নৌকা নিয়ে যেতে হবে মধ্যচরে। এরপর হেঁটে অন্তত দুই কিলোমিটার চর পাড়ি দিয়ে যেতে হবে বাড়িটির কাছে। র‌্যাব সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযান থেকে বাঁচতে এখন দুর্গম চরাঞ্চলকে বেছে নিচ্ছে জঙ্গীরা। যাতে তাদের কার্যক্রম চিনতে কারও কোন সন্দেহ না হয় এবং নিরাপদে তারা তাদের কাজ করতে পারে। র‌্যাবের কর্মকর্তারা জানান, ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির উপাদান উদ্ধার হওয়ায় প্রমাণিত হয়, এই আস্তানাকে ঘিরে জঙ্গীরা রাজশাহী অঞ্চলে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। সেখানেই বোমা তৈরি করা হতো।
×