ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যবস্থাপত্র ও বাস্তবতা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৩০ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যবস্থাপত্র ও বাস্তবতা -স্বদেশ রায়

এ মাসের ২৩ তারিখে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা রিফিউজি প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি ব্যবস্থাপত্র সই হয়েছে। এই ব্যবস্থাপত্র সই হওয়ার ভেতর দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, রোহিঙ্গা রিফিউজি সমস্যাটি এখন দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পার্লামেন্টে বলেছেন, সমস্যাটির সমাধান দ্বিপাক্ষিকভাবে হবে। রোহিঙ্গারা কোন স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠী নয়। বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের কোনরূপ আন্দোলন, সংগ্রামে সমর্থন দেয়ার জন্য তাদের আশ্রয় দেয়নি। বাংলাদেশ মানবিকতার দায় থেকে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। তাই এ ধরনের ক্ষেত্রে বিষয়টির সর্বশেষ সমাধান দ্বিপাক্ষিকভাবেই করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমার কোনমতেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না এবং এমন কোন চুক্তিতে আসবে না যাতে সকল রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক চাপ যে অব্যাহত রাখতে হবে সে বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার অনেক বেশি সচেতন, তার প্রমাণ ২৬ ও ২৭ তারিখে অনুষ্ঠিত বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের ৫৪ রাষ্ট্রদূতের সম্মেলন। ২৩ তারিখ ব্যবস্থাপত্রে সই হওয়ার পরে ২৬ তারিখে প্রধানমন্ত্রী ওই সম্মেলনে যে বক্তব্য রাখেন তার মূল সুর ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা। আমাদের রাষ্ট্রদূতরা সংশ্লিষ্ট দেশগুলো অর্থাৎ যারা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও সমাধান করতে সহায়তা করতে পারে, তাদের কাছে যেন আমাদের রাষ্ট্রদূতরা বিষয়টি তুলে ধরেন, তারা যেন সাহায্য করেন, মিয়ানমারের ওপর চাপ রাখেন সে লক্ষ্যেই তাদের কাজ করতে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়েছে, অর্থাৎ তিনি শুরু থেকে এই সমস্যা সমাধানের প্রতিটি ধাপে যথাসিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যেমন রোহিঙ্গা শরণার্থী স্রোত শুরু হলেই তিনি সরকারপ্রধান হিসেবে সেখানে যান এবং বিষয়টি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন। তার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতিসংঘে তিনি বিষয়টি অনেক দেশের নজরে আনতে সমর্থ হন। বাস্তবতা হলো, এই কলামে আগেও লিখেছি বা বিদেশী পত্রপত্রিকায় আমার অন্যান্য লেখায়ও লিখেছি, রোহিঙ্গা রিফিউজি ইস্যুটি একটি অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ফল। বর্তমানের এই অর্থনৈতিক আগ্রাসনের সময়ে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে এ সমস্যা সমাধান করা বেশ জটিল কাজ। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দৃশ্যত মিয়ানমারের সেনা অত্যাচারের শিকার বলে চিহ্নিত হলেও বাস্তবে তারা চায়নার অর্থনৈতিক স্বার্থের শিকার। রাখাইন বাস্তবে চায়নার ভবিষ্যত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। সেখানে সিটওয়ে বন্দর নির্মাণ করার জন্য চায়না ৭.৩ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার বিনিয়োগ করেছে। রাখাইন থেকে উনান পর্যন্ত তেল ও গ্যাস পাইপলাইন সংযোগ করতে ২.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগ আরও বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। এই পোর্ট ও তেল-গ্যাস লাইনকে কেন্দ্র করে চায়না সেখানে গড়ে তুলবে অনেক স্পেশাল ইকোনমি জোন। এমতাবস্থায় চায়নার যেমন সেখানে জমি প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সন্ত্রাসী শূন্য করার নিশ্চয়তা। রোহিঙ্গাদের ভেতর অতি অল্প হলেও পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের সহযোগিতায় একটি জঙ্গী গ্রুপ আছে। যারা চায়নার এই তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের জন্য হুমকি। তাই এই মানুষগুলো রিফিউজি হওয়ার পেছনে এই ভূমি দখল ও জঙ্গী উচ্ছেদ দুটো বিষয় কাজ করেছে। আর এর ভেতর দিয়ে পৃথিবীতে এটা আরও একবার দেখা গেল অর্থনীতির স্বার্থে কোন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগোষ্ঠী কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। বাস্তবতা হলো, এসব সত্য মেনে নিয়েও বিশ্বমানবতা ও সঠিক কূটনীতি এই দুইকে পুঁজি করে এগোতে হবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করার জন্য। চীনের সঙ্গেও এখানে বাংলাদেশকে বারবার বসতে হবে। যেমন অনেকেই মনে করছে এই মাসের প্রথম দিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করার ভেতর দিয়ে অন্তত এটুকু সফলতা এসেছে, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ একটি ব্যবস্থাপত্রে সই করতে পেরেছে। চায়না অন্যদিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভেতরের এই রিফিউজি সমস্যা সমাধানের জন্য তিন স্তরের একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তিন স্তরের প্রস্তাবটির মূল বক্তব্য হলো, অবিলম্বে রাখাইন স্টেটে যে কোন ধরনের সশস্ত্র হামলা বন্ধ করতে হবে, নতুন করে যাতে কেউ আর রিফিউজি না হন, সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পুনর্বাসনের জন্য যে অর্থনৈতিক সাহায্য দরকার সেখানে চায়না সাহায্য করবে। চীন খুব ভাল বন্ধু মিয়ানমারের, বলা যেতে পারে চীনের শতভাগ বেলি স্টেট মিয়ানমার। অন্যদিকে বাংলাদেশও চীনের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব রক্ষা করে। বাংলাদেশকে চীন গুরুত্ব দেয় তার প্রমাণ তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর, তিন স্তরের প্রস্তাব ও ২৩ তারিখের ব্যবস্থাপত্রে সই হওয়ার পেছনে তাদের ভূমিকা। তবে তার পরেও চীনের তিন স্তরের এই প্রস্তাবে গুরুত্ব পেয়েছে অর্থনৈতিক দিকটি- রাজনৈতিক দিক গুরুত্ব পায়নি। চায়নার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দিক গুরুত্ব পায়নি বলে যে ভবিষ্যতে পাবে না এমন কোন কথা নেই। কারণ, কূটনৈতিক পথে যখন কোন সমস্যার সমাধান করতে হবে তখন একদিনেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। চায়না এখন সব কিছুকে তাদের অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখছে। তাই বলে এখানেই চায়না থেমে যাবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। এখন থেকে কিছুদিন আগেও চায়না সাউথ চায়না সি নিয়ে যা ভাবত, অন্যদিকে আমেরিকা যা ভাবত- এখন দুই দেশই ঠিক শতভাগ আগের অবস্থানে নেই। সময়ের পথ ধরেই কূটনীতির পথে বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয়। আর এ লক্ষ্যে বাংলাদেশকে এগোতে হবে যাতে চায়না বিষয়টির রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে সমর্থ হয়। বিষয়টির মূলে রয়েছে যে, রাখাইন মুসলিম বা রোহিঙ্গাদের সে দেশে সমমর্যাদার নাগরিকত্ব দেয়া। এই রাজনৈতিক সমাধানের দিকটি চায়নাকে বোঝাতে হবে। চায়না এর রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝলে তখন দৃশ্যপট ধীরে ধীরে পরিবর্তন হবে। আর এ জন্য দরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামত। এ মাসের ২৩ তারিখ যে ব্যবস্থাপত্র সই হয়েছে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে, এ কেবল ব্যবস্থাপত্র, সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি নয়। এ নিয়ে আমাদের দেশের ভেতর কিছু কিছু রাজনৈতিক দল সরকারকে সমালোচনা করছে। তাদের সমালোচনা শুধু সমালোচনার জন্য। তাদের কাছ থেকে জাতি বা আমরা সাংবাদিকরা জানতে পারিনি, কী করা উচিত ছিল? আর এখানেই বাংলাদেশের রাজনীতির দীনতা। যখন যে বিরোধী দলে থাকে তখন সে শুধু সমালোচনা করে, বলতে পারে না কী করা উচিত ছিল? ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মের যে রাজনৈতিক দলগুলো আসবে এ দীনতা তাদের অবশ্যই কাটিয়ে উঠতে হবে। যা হোক, রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে কোনরূপ গঠনমূলক সমালোচনা না পেলেও একজন সাংবাদিক হিসেবে, ২৩ তারিখের সই হওয়া ব্যবস্থাপত্রটির একটি ত্রুটি মনে হয়েছে। যেহেতু দুই দেশ সম্মত হয়েছে তারা শরণার্থীদের নিজ ভূমিতে ফেরার ব্যবস্থা করবে এবং এ লক্ষ্যে ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করবে। তাই মনে হয়েছে, এই ব্যবস্থাপত্রে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী- ১৯৯২তে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে মিয়ানমারে শরণার্থীদের ফেরত যাওয়ার ক্ষেত্রে, ওই শর্তে এখনই না গেলে ভাল করতেন। বরং এটা পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে কোন লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ওয়ার্কিং গ্রুপের কাজের ভেতর এটাকে রাখা যেতে পারত। ১৯৯২-এর ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে চুক্তি হয় সেখানে মূলত মিয়ানমারের শর্তই প্রাধান্য পায়। যেমন কোন না কোন একটা ডকুমেন্ট দেখাতে হবে মিয়ানমারের নাগরিককে মিয়ানমারে ফেরার জন্য। এই এক শর্তেই তো অর্ধেকের বেশি শরণার্থী ফেরার বাধা। রজুমার ধর্ষিতা হওয়ার কাহিনী গোটা বিশ্বই এখন জানে। ধর্ষিতা রক্তাক্ত ওই রজুমার পক্ষে কী সম্ভব ছিল কোন ডকুমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসা, যা প্রমাণ করে সে মিয়ানমারের নাগরিক! বাস্তবে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকার ও মিয়ানমার সরকার যখন চুক্তি করেছিল তখন আমাদের বাংলাদেশ সরকার খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি রোহিঙ্গা বিষয়টিকে। বরং তাদের ভেতর থেকে অনেকই চাচ্ছিল রোহিঙ্গারা এখানে থেকে যাক। তাই ’৯২-এর চুক্তির সার কথা- এক. রোহিঙ্গাকে ফিরতে হলে তাকে যথাযথ ডকুমেন্ট উপস্থাপন করতে হবে। দুই. কোনরূপ আপত্তি এলে সেখানে শেষ অবধি মিয়ানমারের কথাই ঠিক হবে। এবারও ঠিক অমনটি এসেছে ব্যবস্থাপত্রে। যদি ব্যুরোক্র্যাটিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখা হয় তাহলে ব্যবস্থাপত্রে ৯২-কে মেনে নেয়ার ভেতর কোন ভুল নেই। কারণ, একই ধরনের সমস্যায় বাংলাদেশ আগে যেটা মেনেছে এবারও তাকে সেটাই মানতে হবে। তবে ব্যুরোক্র্যাট ও ব্যুরোক্রেসির সঙ্গে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদের পার্থক্য এইখানে যে, তারা ঘটনাকে পরিবর্তন করতে, ভিন্নখাতে নিতে জানেন। যেমন ’৯২ সালে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থী আসে তখন বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকীকরণ তো দূরে থাকুক জাতীয় পর্যায়েও আনেনি তৎকালীন সরকার। কারণ তখন সরকারপ্রধান ওই অর্থে বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন না। আর এবার সূচনাতেই শেখ হাসিনা বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এখনও কোন বড় শক্তির কার্যকরী সহায়তা না পেলেও বিষয়টি এগোচ্ছে। তাই ’৯২ সালের ওই শর্তগুলো এখনই না মেনে নিলে ভাল হতো। তবে এখনও সময় আছে, এই ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে যেসব বাধা আসবে সেগুলোকে চিহ্নিত করেই ভবিষ্যতে সমঝোতা স্মারক, তার পরে হয়ত চুক্তি হবে। সে সময়ে ’৯২ সালে রিফিউজিদের ফিরতে যে শর্ত মিয়ানামার দিয়েছে আর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার সেগুলো যেভাবে মেনে নিয়েছিল সেখান থেকে সরে এসে বাস্তবভিত্তিক একটি পথ বের করতে হবে। মূলত দুই দেশ মিলে এমন পথ ঠিক করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে সকল শরণার্থী দেশে ফিরে যায়। অন্যদিকে ক্ষুদ্র হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আরও দুটি বাধা আছে- এক. বাংলাদেশের কিছু মৌলবাদী দল এবং রোহিঙ্গা জঙ্গী গ্রুপগুলো। দুই. বাংলাদেশের কিছু এনজিও- যারা এটাকে নিয়ে ব্যবসা করে। এই দুই গ্রুপই কিন্তু সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে চায়। তাই এই দুই সমস্যাকেও বাংলাদেশ সরকারকে মোকাবেলা করতে হবে। [email protected]
×