ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টেকনাফ বন্দরে পুরোদমে চলছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম

ফের টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

ফের টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য শুরু

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ মাসখানেক অচলাবস্থার পর গতি ফিরে পেয়েছে টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য। অক্টোবর এক মাসেই টেকনাফ স্থলবন্দর কাস্টমস রাজস্ব আয় করেছে ৯ কোটি ৫৫ লাখ ৯১ হাজার ৮৯৪ টাকা। যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত মাসিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ কোটি ৪১ লাখ ৯১ হাজার ৮৯৪ টাকা বেশি। অক্টোবর মাসের জন্য জাতীয় এনবিআরের নির্ধারিত মাসিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ কোটি ৪ লাখ টাকা। জানা যায়, অক্টোবর মাসে টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে ৪৮ কোটি ৫৮ লাখ ৪৯ হাজার ৮৭৫ টাকা মূল্যের পণ্য মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়ে এসেছে। এতে ৪৮ কোটি ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ২৪০ টাকা মূল্যের পণ্য শুল্কযুক্ত এবং ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৬৩৫ টাকা মূল্যের পণ্য শুল্কমুক্ত। ৩১১টি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে পণ্য আমদানি খাতে টেকনাফ স্থলবন্দর কাস্টমস রাজস্ব আয় করেছে ৯ কোটি ৫৫ লাখ ৯১ হাজার ৮৯৪ টাকা। ভয়াবহ রোহিঙ্গা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও অক্টোবর মাসে শাহপরীর দ্বীপ ক্যাডল করিডোর দিয়ে ৮ হাজার ৭৮৭টি গরু, ১ হাজার ৮৮টি মহিষ এবং ৩১৪টি ছাগল আমদানি হয়েছে। প্রতিটি গরু ও মহিষ ৫শ’ টাকা এবং ছাগল প্রতিটি ২শ’ টাকা হারে এ খাতে টেকনাফ স্থলবন্দর কাস্টমস রাজস্ব আয় করেছে ৫০ লাখ ৩শ’ টাকা। তাছাড়া অক্টোবর মাসে ২৭টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৩৯৪ টাকা মূল্যের বাংলাদেশী পণ্য টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারে রফতানি হয়েছে। তন্মধ্যে ১১টি চালানে ৮৪ লাখ ৮ হাজার ৬৫৮ টাকা মূল্যের ১৩২.৬৪৪ মেট্রিক টন বাংলাদেশী গেঞ্জি, ১টি চালানে ১ লাখ ৪ হাজার ৪৫৮ টাকা মূল্যের ১.২৭৮ মেট্রিক টন মানুষের চুল, ২টি চালানে ১ লাখ ৪ হাজার ৬২২ টাকা মূল্যের ১.১৬ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ, ৪টি চালানে ৯ লাখ ৪৮ হাজার ১৩৪ টাকা মূল্যের ৫.৮ মেট্রিক টন পাইস্যা মাছ, ১টি চালানে ৬ হাজার ১৩০ টাকা মূল্যের ০.১৫ মেট্রিক টন চিপস, ৫টি চালানে ৩ লাখ ৭৮৭ টাকা মূল্যের ০.৯২ মেট্রিক টন ফিসিপলেটস, ১টি চালানে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৬৭৭ টাকা মূল্যের ১.১৩ মেট্রিক টন গাজী প্লাস্টিক ট্যাংক, ১টি চালানে ১ লাখ ৩ হাজার ৮০৪ টাকা মূল্যের ১.০০০ মেট্রিক টন এ্যালুমিনিয়াম প্রোডাক্টস, ১টি চালানে ১ লাখ ৪৭ হাজার ১২৪ টাকা মূল্যের ০.৬ মেট্রিক টন বাংলাদেশী লুঙ্গি। তুলনামূলক সেপ্টেম্বর মাসে ১৪১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি হয়েছিল মাত্র ২৮ কোটি ৪৭ লাখ ২২ হাজার ৬৬২ টাকা মূল্যের পণ্য। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৬৭ লাখ ১৬১ টাকা। এ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩৯ টাকা কম আয় হয়েছে। রফতানি বাণিজ্যের চিত্র ছিল আরও শোচনীয়। আগে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের শতাধিক চালানে বিভিন্ন প্রকারের বাংলাদেশী পণ্য টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে মংডু টাউনশিপে রফতানি হতো। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ১৬টি চালানে ৩৭ লাখ ৯১ হাজার ৮৯২ টাকা মূল্যের ৭ প্রকারের বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪টি চালানে ২৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৩ টাকা মূল্যের ৪৪.৪৮ মেট্রিক টন বাংলাদেশী গেঞ্জি, ৩টি চালানে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬০ টাকা মূল্যের ১.৯২ মেট্রিক টন মানুষের চুল, ৩টি চালানে ৯ হাজার ৮১০ টাকা মূল্যের ০.০৮ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ, ২টি চালানে ৭ লাখ ৩ হাজার ৫০ টাকা মূল্যের ৫.৯ মেট্রিক টন ফাইস্যা মাছ, ১টি চালানে ৩০ হাজার ৬৫৬ টাকা মূল্যের ০.৭৫ মেট্রিক টন চিপস, ২টি চালানে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৫ টাকা মূল্যের ০.৮২৫ মেট্রিক টন ফিসিপলেটস, ১টি চালানে ৬১ হাজার ৫৫৮ টাকা মূল্যের ১.৫ মেট্রিক টন জুট ব্যাগ। তবে কুরবানির ঈদের মাসে হওয়ায় গবাদিপশু আমদানি খাতে আয় ভাল ছিল। ঈদের আগে থেকেই দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছিল। সেই সঙ্গে অবৈধ পথে গবাদিপশু এসেছে প্রচুর। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গবাদিপশু আমদানির জন্য টেকনাফের হ্নীলা ও শাহপরীর দ্বীপ ২টি ক্যাডল করিডোর রয়েছে। তন্মধ্যে হ্নীলা করিডোর দিয়ে কোন গবাদিপশু আমদানি হয়নি। শাহপরীর দ্বীপ ক্যাডল করিডোর দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে মোট গবাদিপশু আমদানি হয়েছে ৯ হাজার ৯৪২টি। এর মধ্যে ৬ হাজার ৯৪৬টি গরু, ৪৩০টি মহিষ, ২ হাজার ৫৬৬টি ছাগল। রাজস্ব আয় হয়েছে ৪২ লাখ ১ হাজার ২শ’ টাকা। উল্লেখ্য, ২৫ আগস্ট ভোর রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংস ঘটনার পর ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের মংডু শহর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে সীমান্ত বাণিজ্যের কোন পণ্য আসেনি। অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে যায় টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য। ব্যবসায়ীদের মংডু টাউনশিপের কর্তৃপক্ষ টেকনাফ বন্দরে মালামাল আনতে দেয়নি। তবে স্বল্প পরিসরে আকিয়াব (সিটওয়ে) থেকে পণ্য আমদানি হয়েছিল। রফতানি বাণিজ্যের চিত্র ছিল আরও শোচনীয়। মিয়ানমারের মংডু কর্তৃপক্ষ একতরফা ও অঘোষিতভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রাখায় রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছিল। টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। আগে যেখানে প্রতিমাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার পরও কয়েক কোটি টাকা বেশি আয় হতো, সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি। এমনকি টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মংডু টাউনশিপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থলবন্দরে আটকা পড়েছিল। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যের এই পয়েন্টটি ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’ নামে পরিচিত এবং পরিচালিত। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর টেকনাফ এবং মংডু টাউনশিপে পৃথকভাবে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেই থেকে উভয় দেশের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বাণিজ্য সম্প্রসার করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেকারদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংস ঘটনায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সীমান্ত রক্ষা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোপরি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ সংযম, ধর্য, কৌশল, দক্ষতা প্রদর্শনপূর্বক পরিস্থিতি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। যা দুনিয়াজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।
×