ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিস্ফোরণে হত ৩, আটক ৪;###;পিস্তল, গ্রেনেড, বোমাসহ শক্তিশালী বিস্ফোরক জব্দ;###;ভেস্তে গেছে বড় নাশকতার ছক;###;এনজিওর নামে আস্তানা গড়েছিল জঙ্গীরা

পদ্মার চরে জঙ্গী ডেরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

পদ্মার চরে জঙ্গী ডেরা

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী/ ডিএম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত সংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দুর্গম পদ্মার নির্জন চরের বাথান বাড়িতে এবার জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মিলেছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা সদর থেকে পদ্মা নদী পেরিয়ে অন্তত চার কিলোমিটার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দুরে চর আলাতুলি ইউনিয়নের মধ্যচরে এ আস্তানার অবস্থান। কাশবনের ছন ও বাঁশের খুটি দিয়ে গড়ে তোলা খুপরি ঘর আকৃতির বাথান বাড়িতেই গড়ে তোলা হয় জঙ্গী আস্তানা। গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নের বেনীপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে চরের এ অস্তানার দুরস্ত ২০ কিলোমিটার। মঙ্গলবার ভোরে এবার সেই চরে অভিযান অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। গোলাগুলি ও বিষ্ফোরণের পর এ অস্তানা থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এরা সবাই জেএমবির সক্রিয় সদস্য। পরে চাপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় তিন জঙ্গির ছিন্নভিন্ন লাশ। মঙ্গলবার দুপুরে র‌্যাবের একটি দল বিষ্ফোরনে পুড়ে যাওয়া ছিন্নভিন্ন তিনজনের লাশ উদ্ধার করে ওই আস্তানা থেকে। পরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান মুফতি মাহমুদ। এর আগে হেলিকপ্টারযোগে র‌্যাবের এডিজি (অপস) আনোয়ার লতিফ ঘটনাস্থলে পৌছেন। তিনি বলেন, এখান থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বিষ্ফোরনেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া চারজনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে দুটি পিস্তল, তিনটি শক্তিশালী গ্রেনেড, সাতটি ডেটেনেটর, ১২ টি পাওয়ার জেল ও বিপুল পরিমান বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত তিনজনের পরিচয় পাওয়া না গেলেও তারা জেএমবির সক্রিয় সদস্য বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে জঙ্গি সন্দেহে দম্পতিসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। দুপুরে র‌্যাবের বোমা নিস্ক্রীয়কারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনজনের দগ্ধ ও ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আটককৃতরা হলো, ওই বাথানবাড়ির মালিক রাশিকুল ইসলামের স্ত্রী শামিমা খাতুন ওনফে নাজমা (৪০), নাজমার মা মিনারা (৫৫) বাবা খোরশেদ আলম (৬০) ও নাজমার ৬ বছর বয়সি শিশু কন্যা তারাবানু। বাড়ির মালিক রাশিকুল ইসলাম আলাতুলি নতুনপাড়ার আতাউর রহমান ওরফে কালুর ছেলে। সে বাথান বাড়িতেই তার স্ত্রী, শ^শুর ও শাশুড়ি ও ১৫ বছর বয়সি এক ছেলে ও ৬ বছরের মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। তাদের আদি বাড়ি গোদাগাড়ী উপজেলার শাহাব্দিপুরে। স্থানীয় চরআলাতুলি ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মেসবাউল হক কালু জানান, বাথান বাড়ির মালিক রাশিকুল, তার স্ত্রী, ১৫ বছর বয়সি এক ছেলে এবং তার শ্বশুর থাকতেন। তবে মালিক রাশিকুল ইসলাম ক্যান্সারে আক্রান্ত। বছর চারেক আগে ভেড়া ও মহিষ পালনের সুবিধার জন্য তিনি ওই বাথান বাড়িটি বানিয়েছিলেন। ওই বাথান বাড়ির আশেপাশে এক কিলোমিটার এলাকায় কোন ঘর-বসতি নেই। নির্জন এলাকা হওয়ায় বাড়িটিতে জঙ্গি কার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে তারা কিছু টের পাননি। মঙ্গলবার ভোরে অপারেশন শুরুর পর তারা বুঝতে পারেন, এখানে দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছিলো। তিনি বলেন, বাথান বাড়িতে নিহতরা কে বা কারা, কবে থেকে এখানে আস্তানা গেড়েছে সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তবে নির্জন বাথান বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার খবরে তারা শঙ্কিত। তিনি বলেন, রাত থেকেই শঙ্কার মধ্যে রয়েছে পুরো চরের মানুষ। জঙ্গি আস্তানা এ বাথান বাড়ি থেকে ভারতীয় সীমান্ত রেখা মাত্র দেড় কিলোমিটারের পথ। এর আগে মঙ্গলবার ভোররাতে পদ্মার ওপারে চরআলাতুলি ইউনিয়নের মধ্যচর এলাকার ওই বাথান বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় র‌্যাব। এরপর সেখানে র‌্যাব সদস্যরা অভিযানে গেলে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। পরে বিস্ফোরণে বাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। এরপর থেকে বাড়িটি ঘিরে অভিযান চালায় র‌্যাব সদস্যরা। খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় র‌্যাবের বোমা নিস্ক্রীয়কারী দল। এরপর সেখানে অভিযান শুরু করে দলটি। এরআগে ঘটনাস্থলে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান মুফতি মাহমুদ সংবাদিকদের জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাত থেকেই ঘিরে রাখা হয় বাড়িটি। এরপর ভোররাতে সেখানে অবস্থানকারীদের আত্মসমর্পণের আহবান জানানো হয়। কিন্তু সাড়া না দিয়ে উল্টো বাড়ির ভেতরে দুই দফা বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। র‌্যাব-৫ (রাজশাহী) অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুব আলম জানান, ভোররাতে বাড়িটিতে অভিযানের শুরুতেই সেখান থেকে গুলি ও গ্রেনেড ছুঁড়ে দুর্বৃত্তরা। পরে বিস্ফোরণ ঘটালে বাড়িটির একটি অংশে আগুন ধরে যায়। আত্মসমপর্ণের আহবানেও সাড়া দেয়নি জঙ্গিরা, উল্টো গ্রেনেড ছুড়ে ॥ র‌্যাব সূত্র জানায়, অভিযান শুরুর পর থেকেই বারবার আত্মসমপর্ণের আহবান জানানোর পরেও সাড়া দেয়নি জঙ্গি আস্তানার সদস্যরা। উল্টো র‌্যাবকে লক্ষ্য করে তারা বাড়ির ভিতর থেকে পাল্টা দুই দফা বিস্ফোরণ ঘটায়। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়ে। একপর্যায়ে বাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। এতে বাড়িটি পুড়ে গেছে। র‌্যাব সদস্যরা জানান, রাত থেকে ঘিরে রাখা হয় বাড়িটি। এনজিও’র নামে বাড়ি ভাড়া নেয় জঙ্গিরা ॥ বাথান বাড়ির জঙ্গি আস্তানায় বেশ কিছুদিন থেকেই ঘোরাঘুরি করছিলো জঙ্গিরা। তারা যে জেএমবির সক্রিয় সদস্য তা বাড়ির মালিক রাশিকুল বুঝতে পারেন নি। ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রায় অচল রাশিকুল জানান, এক সপ্তাহ আগে দুজন অপরিচিত লোক এসে এনজিও অফিস করা হবে বলে বাড়িটি ভাড়া চান। এতে অবাক হন তিনি। তিনি বলেন, খড়ের বাথান ঘর কিভাবে এনজিও অফিস হতে পারে। তিনি ভাড়া দিতে না চাইলে তারা ফিরে আসে। তিনদিন আগে আবার তারা সেখানে গিয়ে ভাড়া চান ঘরটি। আবারো না বলে দেন রাশিকুল। শেষে ২৮ নবেম্বর পর্যন্ত সেখানে তারা থাকবেন বলে সেখানে আস্তানা গড়ে তোলে জঙ্গিরা। এরইমধ্যে র‌্যাব টের পেয়ে মঙ্গলবার সেখানে অভিযান চালায়। তবে র‌্যাবের ভাষ্য ১৫ দিন আগে জেএমবির সদস্যরা এ বাথান বাড়িটি ভাড়া নিয়ে সেখানেই আস্তানা গড়ে তুলেছিলো। তারা নিজেদের বেসরকারি সংস্থার সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। বাড়ির মালিককে বলেছিলো- তারা পাখিপ্রেমি। বাড়িটিতে থেকে চরাঞ্চলের পাখিদের ছবি তুলবেন তারা। আস্তানার খোঁজ মীরপুরের জঙ্গিবাড়ি থেকে ॥ রাজধানীর মীরপুরে গত ৫ সেপ্টেম্বর জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নব্য জেএমবি আবদুল্লাহ’র নিহতের পর অভিযানে গ্রেফতার অপর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরেই র‌্যাব রাজশাহী অঞ্চলে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায়। র‌্যাব জানতে পারে, রাজশাহীর কোনো দুর্গম এলাকায় আস্তানা গেড়ে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এরপর এ অঞ্চলে বৃদ্ধি করা হয় গোয়েন্দা নজরদারি। শেষ পর্যন্ত রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত সংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দুর্গম পদ্মার নির্জন চরের বাথান বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় র‌্যাব। এরপর সোমবার দিবাগত রাত থেকেই চিহ্নিত ওই বাড়িটি ঘিরে রাখা হয়। প্রথমে র‌্যাবের পক্ষ থেকে মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হলেও সারা কোনো সাড়া দেয়নি। এক পর্যায়ে ওই বাথান বাড়ি থেকেই র‌্যাবকে লক্ষ্য করে কয়েক দফা বিস্ফোরণ বোমা ও গ্রেনেডের বিষ্ফোরণ ঘটানো হয়। র‌্যাব জানান, ঢাকার মিরপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর তাদের এই পরিকল্পনার খবর জানা যায়। র‌্যাব জানতে পেরেছিল, চরাঞ্চলে অবস্থান করে তারা জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে স্থানীয় একটি সূত্র চরের এই বাড়িটি ভাড়া নেয়ার খবর জানায়। এরপর র‌্যাব বাড়িটিতে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী, মঙ্গলবার ভোররাতে এই বাড়িটি ঘিরে ফেলা হয়। র‌্যাব জানিয়েছে, বাথানবাড়িতে তাদের অভিযান শেষ করার পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা পুলিশও নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। টার্গেট ছিলো রাজশাহী অঞ্চলে বড় ধরনের নাশকতার ॥ রাজশাহী অঞ্চলে বড় ধরনরে নাশকতার পরিকল্পনা ছিলো জঙ্গিদের। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষ করার পর এমনই তথ্য জানান র‌্যাবের মিডিয়া উইয়িংসের পরিচালক মুফতি মাহমুদ। তিনি জানান, বড়ধরনের নাশকতা করার লক্ষ্যে তারা দূর্গম চরের ওই বাড়িটি ভাড়া নেয়। প্রথমে নিজেদের এনজিও কর্মী হিসেবে ও পরে পাখি-প্রেমি সেজে আস্তানা গাড়ে। তাদের কাছে ক্যামেরাও ছিলো। তিনি জানান, জঙ্গি আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তিশালী বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে এগুলোয় তার প্রমাণ। তবে র‌্যাবের সক্রিয় গোয়েন্দা তথ্যের কারনে রাজশাহী অঞ্চলে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। প্রসঙ্গত, এর আগে রাজশাহী অঞ্চলে সর্বশেষ জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয় ১১ জুন রাজশাহীর তানোর উপজেলার নিভৃত গ্রাম পাঁচন্দর ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়ায়। সেখান থেকে ‘জঙ্গি’ সন্দেহে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। নারী ও শিশুসহ আরও নয়জনকে হেফাজতে নেওয়া হয় ওই বাড়ি থেকে। এর আগে চলতি বছরের ১১ মে জেলার গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নের বেনীপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান ‘সানডেভিলে’ দমকল বাহিনীর এক সদস্যসহ ৫ জঙ্গি নিহত হয়। এরপর রাজশাহী অঞ্চল থেকেই গ্রেফতার করা হয় নব্য জেএমবির অন্যতম ক্যাডার সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজকে।
×