ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরও তিন শতাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ অপেক্ষায় আছে বহু

রাখাইনের পরিস্থিতি এখনও সংঘাতময়

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

রাখাইনের পরিস্থিতি এখনও সংঘাতময়

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ কোনভাবেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থামছে না। সোমবার গভীর রাতের পর থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আরও তিন শতাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ ও লম্বরিপাড়া পয়েন্ট দিয়ে। নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের পক্ষে জানানো হয়েছে রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্র মগ সন্ত্রাসীদের নানামুখী নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি এখনও সংঘাতময়। ফলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। উত্তর মংডুতে এখনও বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। সুযোগ বুঝে তারা চলে আসছে। এদিকে ক্যাথলিক খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের শীর্ষধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সফরে থাকা অবস্থায় বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় আউং সান সুচির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে যে নিন্দার ঝড় উঠেছে তার জের হিসাবে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড শহরের নগর কাউন্সিল ইতোপূর্বে আউং সান সুচিকে দেয়া সম্মাননা ‘ফ্রিডম অব দি সিটি’ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সুচির এ খেতাব প্রত্যাহারের পক্ষে ভোটাভুটির পর তা কেড়ে নেয়া হয়েছে। অপরদিকে রাখাইন রাজ্যের ঘটনা নিয়ে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে মিথ্যাচার অব্যাহত রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধনের যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বিচ্ছিন্নভাবে এখনও অব্যাহত রয়েছে তা তারা কোনভাবে স্বীকার করছে না। উল্টো রোহিঙ্গাদের বাঙালী আখ্যায়িত করে সহিংস ঘটনার জন্য তাদের দায়ী করা হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহু দেশ এবং সংস্থার পক্ষ থেকে প্রমাণসমেত রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া ও বিতাড়িত হওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরা হলেও সে দেশের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচি এবং সেনা প্রধান জেনারেল মিং তা বরাবরই অস্বীকার করে চলেছেন। বর্তমানে মিয়ানমার সফররত পোপ ফ্রান্সিসকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারে কোন ধর্মীয় বৈষম্য নেই, প্রত্যেকে ধর্মীয় স্বাধীনতা পাচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টির পর আউং সান সুচির ২৯ নবেম্বর তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীন যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে এ সফর রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে কিনা তা নিয়ে কোন তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে সমঝোতা স্মারক হওয়ার পর কবে নাগাদ তা শুরু হবে তা এখনও অনিশ্চিত। এ অবস্থায় সরকার রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তচ্যুত এক লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসনে নোয়াখালীর ভাষানচরে ২৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে মঙ্গলবার। একনেকে তা অনুমোদিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে ॥ লাখ লাখ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে কক্সবাজারের সামগ্রিক পরিবেশ দিন দিন জটিল হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন রোহিঙ্গা পালিয়ে আসছে রাখাইন থেকে। যুক্ত হচ্ছে পুরনোদের সঙ্গে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রাণান্তকর প্রয়াস অব্যাহত রাখলেও মিয়ানমারের পক্ষে আশানুরূপ তেমন কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তারা আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে চারটি শর্ত সাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। এসব শর্তের আলোকে রোহিঙ্গাদের মাঝে নিজ দেশে অর্থাৎ মিয়ানমারে ফিরে যাবার ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ বা উৎসাহ নেই বললেই চলে। রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে মোবাইল ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির ফলে রোহিঙ্গারা সেখানে গোপনে ব্যবহার করত বাংলাদেশী অপারেটরের মোবাইল ফোন। বাংলাদেশে আশ্রিত হওয়ার পর তারা ত্রাণ বিক্রি করে আগে হাতিয়ে নিয়েছে একেকটি মুঠোফোন। যদিও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রিত হওয়ার পর নিজস্ব মোবাইল ফোন ব্যবহারে সরকারের নিষেধ রয়েছে। নিষেধ আছে রোহিঙ্গাদের কাছে সিম ও মোবাইল ফোন বিক্রি না করারও। কিন্তু এক শ্রেণীর মোবাইল দোকানি স্থাননীয় বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রেশন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছে ওইসব সিম বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গাদের প্রতিটি পরিবারে কমপক্ষে তিনটি করে মোবাইল সেট ব্যবহার করছে। আশ্রিত কক্ষে রোহিঙ্গা নারীর হাতে অবশ্যই একটি মোবাইল থাকছেই। রোহিঙ্গা পুরুষরা বাইরে শ্রম দিতে অথবা বিকিকিনি করতে গেলে যাতে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিটি ক্যাম্প সন্নিকটে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হলেও সেখানে যায় না রোহিঙ্গারা। রাখাইনে তাদের স্বজনদের সঙ্গে, আরএসও ক্যাডার ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে রাতে দিনে তাদের নিজস্ব সেট দিয়ে রোহিঙ্গারা যোগাযোগ করে চলছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে অপরাজনীতি ॥ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে অপরাজনীতিও চলছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ প্রদর্শন করে তাদের এদেশে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ রোহিঙ্গাগোষ্ঠীর একশ্রেণীর ক্যাডার এ ইস্যুতে দিন দিন অপতৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়ালেও বিএনপি মহাজোট এ নিয়ে এক ধরনের গাত্রদাহ চলছে। বিএনপির পক্ষে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলে অনাহূত বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এরপরও সরকার প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। রোহিঙ্গা ইস্যু বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এরপরও বিএনপির যে তৎপরতা তা অনেকটা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতো বলেই মত দিচ্ছেন স্থানীয় রাজনৈতিকরা। অভিযোগ উঠেছে, আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপ (আরএসও) কিছু ক্যাডার সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে নানামুখী উস্কানি দিচ্ছে। বর্তমানে নতুন ও পুরনো মিলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সরকারকে বেকাদায় ফেলতে অপরাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা যাতে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী না হয় সে বিষয়ে তাদের তৎপর রাখতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। রোহিঙ্গা পুরুষদের নিবন্ধনে আগ্রহ কম ॥ গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে বালুখালী কাশেমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে চলছে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন। কিছু কিছু ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ছাড়া প্রথমে নিবন্ধনমুখী ছিল না রোহিঙ্গারা। পরবর্তীতে ব্যাপক প্রচার চালানো, রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কেন্দ্রে আনা নেয়ার জন্য গাড়ি দেয়া এবং ঐ কার্ড দেখে ত্রাণ দেয়া হবে ঘোষণা দেয়ার পর কেন্দ্রমুখী হয় রোহিঙ্গারা। কিন্তু নিবন্ধন করতে আসাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা বেশি। পুরুষের সংখ্যা নারী ও শিশুদের তুলনায় বহুলাংশে কম। বহু পুরুষ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার হয়েছে। আর যারা পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে তাদের মাঝে নিবন্ধন কাজে আগ্রহের বিষয়টি নিতান্তই কম। এরপরও অনেকে নিবন্ধিত হয়েছে। কিন্তু আশ্রিত পুরুষদের একটি অংশ এখনও নিবন্ধনের আওতায় আসেনি। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় পৌনে ৭ লাখ রোহিঙ্গা নিবন্ধনের আওতায় এসেছে।
×