ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

রিপোর্টারের ডায়েরি

পঙ্গু হাসপাতালই কি পঙ্গু? ৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ১০ মিনিট। সকালে গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। দেখলাম আব্বা ফোন দিয়েছেন। সাধারণত সকাল বেলায় আব্বা ফোন দেন না। কল দেখেই প্রশ্ন জাগলো কোন বিপদ হলো না তো! ফোন রিসিভ করতেই আব্বা জানালেন আমার বড় চাচা ফোরকান ঢালী এক তলার ছাদ থেকে পড়ে মারাত্মক আহত হয়েছেন। আব্বা জানালেন, খুব সম্ভবত ডান হাত ভেঙে গেছে। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। আমি বললাম বিলম্ব না করে ঢাকায় নিয়ে আসেন (ঢাকার কাছে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আউটশাহী গ্রামে আমাদের বাড়ি)। আব্বাকে ঢাকা আসতে বলে আমি একটু খোঁজ খবর নিতে থাকি কোন হাসপাতালে নেয়া যায়। সিনিয়র অনেক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলি। সবাই চাচাকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সবার পরামর্শ অনুযায়ী আব্বাকে জানাই সরাসরি পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসতে। আমিও তাৎক্ষনিকভাবে পঙ্গু হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হই। সকাল ১০টা বাজার আগেই আমি পৌঁছে যাই হাসপাতালে। ঢাকার কাছাকাছি বাড়ি থাকায় চাচাকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে পৌঁছতে বেশি সময় লাগেনি। সোয়া ১০টার দিকে আব্বা চাচাকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে পৌঁছে যান। এই হাসপাতালে পৌঁছানোর পর প্রতিটি মুহূর্তেই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকি। হাসপাতালে আসতেই ট্রলি নিয়ে এগিয়ে আসলেন দু’জন মধ্য বয়স্ক মহিলা। শুরুতে ভাবলাম সরকারী হাসপাতালেও এত ভাল সেবা! ভালই তো। তবে সে সেবা যে কত ভাল সেটা পড়ে বুঝতে পেরেছি। এ বিষয়ে পড়ে আসছি। চাচাকে নিয়ে তাৎক্ষণিক জরুরী বিভাগে গেলাম। সেখানে প্রথমে চাচার হাতের ক্ষত স্থানে ড্রেসিং করে জরুরী বিভাগের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন ওয়ার্ড বয়। ডাক্তার চাচার হাতের এক্সরে করাতে বললেন। গেলাম এক্সরে রুমে। গিয়ে দেখি পাঁচ-ছয়জন রোগী আমাদের আগে সিরিয়ালে আছেন। চাচা তখন ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। আমি এক্সরে অপারেটরকে গিয়ে বললাম আমাদের একটু বেশি জরুরী, আমাদের কি আগে দেয়া যায়? উনি নানা ধরনের নিয়ম দেখালেন। চাচা তখনও ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। ছয় জনের পরেই চাচার এক্সরে করানো হলো। রিপোর্ট দেয়ার আগেই আমার কাছ থেকে চারশ’ টাকা নিয়ে নিলেন এক্সরে রুমের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি। আমি মানি রিসিট চাইলে রিপোর্ট দিতে দেরি হবে বলে জানিয়ে দেন। কি আর করার। পরে জানতে পারলাম এক্সরের সরকারী ফি ২১০ টাকা। অসুস্থ চাচাকে নিয়ে আবার দ্রুত জরুরী বিভাগের ডাক্তারের কাছে চলে যাই। ডাক্তার দেখে বললেন চাচার হাতের দুই যায়গায় ভেঙে গেছে। অপারেশন লাগবে। ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী অপারেশন থিয়েটারের সামনে গেলাম আমরা। এবার আবার সেই দুই মধ্য বয়সী মহিলার কথায় আসি, যারা ট্রলি সরবরাহ করেছিলেন। আমরা চাচাকে ট্রলিতে তোলার পর থেকেই তারা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন। অপারেশন থিয়েটারের সামনে এসে ওই দুই মহিলা আমাদের বললেন এবার আমাদের বিদায় দেন। আমি বললাম ঠিক আছে আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। ওনারা বললেন কিছু দিবেন না। আমি বললাম কি দিব? বললেন, এতক্ষণ কষ্ট করলাম! আমি বললাম, কেন? হাসপাতাল আপনাদের বেতন দেয় না। সাফ জানালেন ওনারা হাসপাতালের স্টাফ না। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে? বলেন রোগীদের কাছ থেকে আমরা টাকা নেই। জানালেন এই টাকার ভাগ অনেক যায়গায়ই দিতে হয়। কথা না বাড়িয়ে আমার আব্বা দুইশত টাকা দিলেন। এই দুইশত টাকায় তারা খুশি হতে পারেননি। পরে আরও একশ’ টাকা দিতে হলো তাদের। এরপর অপারেশন থিয়েটারে আরও অভিজ্ঞতা। আমরা দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে অপারেশন থিয়েটারের সামনে। এখানকার এক ডাক্তার বললেন আমাদের এই রোগীর অপারেশন করতে অজ্ঞান করতে হবে। বললাম তাহলে করেন। জানালেন অপারেশন থিয়েটারে সকালের সিফটে এ্যানেসথেশিস্ট (অজ্ঞান করার ডাক্তার) নেই। ২টার সিফটের ডাক্তার এলে অপারেশন করবে। অপেক্ষা করতে থাকলাম। দুপুর আড়াই টায়ও বিকেলের সিফটের এ্যানেসথেশিস্ট আসছে না। চাচা তখনও ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। চিৎকার করছিলেন। এ সময় আব্বাও আমার ওপর রাগ করছিলেন, ভাল বেসরকারী হাসপাতালে না নিয়ে কেন সরকারী হাসপাতালে আনলাম। অবশেষে বিকেল সাড়ে তিনটায় আসলেন বিকেলের সিফটের ডাক্তার এবং অপারেশন হলো। অপারেশের জন্য কোন রসিদ ছাড়াই ওয়ার্ড বয়রা নিলেন ২ হাজার টাকা। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সকালের সিফটের এ্যানেসথেশিস্ট থাকার কথা ছিলো দুপুর ২টা পর্যন্ত কিন্তু তিনি চলে গেছেন ১২টায়। আর ২টায় যে ডাক্তারের আসার কথা ছিল, তিনি আসলেন বিকেল সাড়ে ৩টায়। ডাক্তারদের কর্তব্যে অবহেলায় বা গাফিলতিতে আমার চাচাকে ভুগতে হলো তিন ঘণ্টা। পুরো সময়টা আমার চাচা ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। শুধু আমরা না, যাদের অজ্ঞান করে অপারেশন করার দরকার ছিল এমন আরও অনেক রোগীদেরই এমন বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয় সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের জন্য। চাচার অপারেশনের পর আমি অফিসে (দৈনিক জনকণ্ঠ) চলে আসি। পরে আব্বার কাছে জানতে পারি চাচাকে রাতে বেডে দিলে সেখানেও টাকা দিতে হয়। ফ্রি বেডের জন্যও ওই ওয়ার্ডের বয় আব্বার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নেয়। আমার চাচা তিন দিন ওই হাসপাতালে ছিলেন। প্রতিটি দিনই কাউকে না কাউকেই টাকা দিতে হয়েছে। এই হাসপাতালের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছিল পঙ্গু হাসপাতাল খ্যাত সরকারী এই হাসপাতালটিই যেন পঙ্গু হয়ে আছে! আরাফাত মুন্না [email protected] একবার না পারিলে দেখ তিনবার! ২২ ডিসেম্বর, সোমবার, ২০১৪। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির বার্ষিক ক্রীড়া উৎসবে টেবিল টেনিসের একক ইভেন্টের ফাইনাল ম্যাচ। ফাইনালে আমার প্রতিপক্ষ টিভি ও বেতারের স্বনামধন্য ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। ফাইনাল ম্যাচটি পরিচালনা করার জন্য রেফারি হিসেবে এগিয়ে এলেন কালের কণ্ঠের শাহজাহান কবীর, যাকে দেখলেই মজা করে বলি, ‘তাজমহলের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা!’ ম্যাচ শুরু হলো। চেষ্টা করলাম স্বাভাবিক এবং সতর্কভাবে খেলতে। ভালই খেললাম। তবে প্রথম সেট হেরে গেলাম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে, ২১-১৮ পয়েন্টে। হারলেও মনে ততক্ষণে অনেকটাই ফিরে এসেছে আত্মবিশ্বাস। কেননা খেলতে গিয়ে আন্দাজ করলাম প্রতিপক্ষের ‘উইক পয়েন্ট’ আসলে কোথায়। খানিকক্ষণের বিরতি। তারপর শুরু হলো দ্বিতীয় সেটের খেলা। নিজের প্রশংসা করা ঠিক না, তারপরও বলতে বাধ্য হচ্ছি, কিভাবে যেন অসাধারণ কিছু চাপ মেরে আদায় করলাম বেশকিছু মূল্যবান পয়েন্ট (খেলা শেষ হবার পর শাহজাহানও বললেন, এতদিন ধরে আপনার সঙ্গে খেলছি, কিন্তু কোনদিন তো এমন চাপ মারতে দেখিনি!’)। দ্বিতীয় সেটে হেরে গেলেই খেলা শেষ। পত্রপাঠ বিদায় সুনিশ্চিত আমার। অথচ ২১-১৬ পয়েন্টে জিতে এলাম সমতায়! জমে উঠল লড়াই। এবার তৃতীয় বা শেষ সেটের পালা। যে জিতবে, সে-ই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। জো জিতা ওহি সিকান্দার! দু’জনেরই অবস্থা তখন ‘কেরোসিন’! পৌষ মাসের শীতেও ঘেমে একাকার। গলা শুকিয়ে চৌচির। যার ফলে খেলা থামিয়ে ঘন ঘন জল পান করতে হচ্ছে দুজনকেই। শেষ সেটে আমি একবার পয়েন্টে এগিয়ে যাই, আবার এগিয়ে যান সালাউদ্দিন ভাই। একপর্যায়ে আমি ২০-১৩ তে এগিয়ে। আর মাত্র ১ পয়েন্ট পেলেই শিরোপাটা ঠাঁই পাবে আমার হাতে। উত্তেজনায় কম্পমান আমি। অথচ ওই সময়ই সবচেয়ে জঘন্য খেললাম। চমৎকার খেলে সালাউদ্দিন ভাই ২০-২০ পয়েন্টে ম্যাচ ‘ডিউজ’ করে ফেললেন! এখন হবে ‘বেস্ট অব সিক্স’ বা টাইব্রেকার। যে আগে ৬ পয়েন্ট পাবে, সে-ই বিজয়ী হবে। চরম শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। নাঃ! আর বুঝি হলো না। তীরে এসে বুঝি ডোবালাম তরী! ওহ্, একি খেললাম আমি? এও কি সম্ভব? টাইব্রেকারে সালাউদ্দিন ভাই নয়, জিতলাম আমিই! তাও আবার অনেকটা ব্যবধান রেখেই (৬-৩)! এ সেটে জিতলাম ২৬-২৩ পয়েন্টে সার্বিকভাবে জিতলাম ২-১ সেটে। অথচ প্রথম সেটে হেরে পিছিয়ে পড়েছিলাম আমি! খেলা শেষ। হতবিহবল ভাব কাটিয়ে সালাউদ্দিন ভাই এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন। জড়িয়ে ধরলেন। নিজের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় আমাদের দু’জনের ছবি ফ্রেমবন্দী করলেন শাহজাহান কবীর। আমার তখনও বুক ধড়ফড় করছে। চোখে যেন সর্ষেফুল দেখছি। তখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না আমিই জিতেছি। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, ফাইনাল হয়েছে ফাইনালের মতোই। টিটিতে এটা আমার তৃতীয় সাফল্য। তবে চ্যাম্পিয়ন হলাম এবারই প্রথম। প্রথমবার অংশ নিই ১৯৯৮ সালে। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আন্তঃহল টিটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সেবার রানারআপ হয়েছিলাম। প্রতিযোগিতা শুরুর মাত্র সাতদিন আগে টিটি খেলা শিখেছিলাম। ফাইনালে হারি আমারই রুমমেট-ছোটভাই জিয়াউল হক রাসেলের কাছে ২-১ সেটে, যে কিনা তখনই এ খেলায় সাত বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন! এরপর এত বছর আর টিটি খেলিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম খেলাটি। তবে কয়েকমাস আগে যখন ক্রীড়ালেখক সমিতিতে টিটি খেলার জন্য প্রথমে ব্যাট-বল-টেবিল কেনা হলো তখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তীব্র গতিময় ও নেশার মতো এই খেলাটি খেলার জন্য। মোটামুটি আবার যখন হাত পাকিয়ে ফেলেছি, তখন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) শুরু হলো ডিআরইউ টিটি। তাতে অংশ নিলাম এবং অধিকার করলাম তৃতীয় স্থান। আর এবার তৃতীয়বারে ক্রীড়ালেখক সমিতির টিটিতে অংশ নিয়ে তো চ্যাম্পিয়নই হয়ে গেলাম। ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার।’ শতবার নয়, তৃতীয়বারের চেষ্টাতেই মুখ দেখলাম সফলতার। ক্রীড়ালেখক সমিতির ইতিহাসে এটাই ছিল টিটির প্রথম কোন টুর্নামেন্ট। আগামীতে হয়তো আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারব না। কিন্তু সমিতির টিটির ‘প্রথম’ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আমার নামটিই থেকে যাবে চিরকাল-এটাই আমার অনাবিল চিত্তসুখের হেতু! রুমেল খান [email protected]
×