ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যার বিশ্বস্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

গণহত্যার বিশ্বস্বীকৃতি

বিশ্বজুড়ে আজ ‘যেখানেই গণহত্যা সেখানেই প্রতিরোধ’ নীতি অবলম্বন জরুরী হয়ে পড়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী বাঙালীর ওপর ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়ে ত্রিশ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা ও তিন লাখের বেশি মা-বোনকে ধর্ষণ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই গণহত্যাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ফলে বিশ্বে একের পর এক গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। যার সর্বশেষ সংযোজন মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান গণহত্যা। চীন, রাশিয়া, ভারত মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিপীড়ন, গণহত্যা, ধর্ষণ, বাস্তুচ্যুত করার কর্মকা-ে সহমত পোষণ করছে। আউং সান সুচি ও সে দেশের সামরিক হানাদার বাহিনীর বিচার না হলে পৃথিবীর কোন গণহত্যার বিচার করার অধিকার আন্তর্জাতিক আদালতের থাকে না। সুদান ও সিরিয়ায় গণহত্যা চলছে, অথচ এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হচ্ছে না। গণহত্যার বিচার পাওয়া দেশে দেশে শহীদ ও নিহতদের এবং তাদের পরিবারের অধিকারের আওতায় পড়ে। কিন্তু এদেশে বিএনপি-জামায়াত গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ জন্য তাদের বিচার হওয়া উচিত হলেও তা করা হচ্ছে না। গণহত্যাকারী পাকিস্তান এখনও গণহত্যার বিচারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছে। নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনকে অস্বীকার করছে। এ জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণার পরপরই তারা পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় বাংলাদেশে তাদের দোসরদের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান নাক গলানোর মতো ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয়টি চাপা পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস চাপা দিতে অতীতে ব্যাপক প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে এবং তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য এটা বাস্তব যে, মার্কিন সহায়তা পেয়েছিল বলেই পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যা নির্যাতন করতে পেরেছিল। কিন্তু ভারত সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার কারণে পাকিস্তানকে পিছু হটতে হয়েছে। একাত্তরে এদেশে যে গণহত্যা হয়েছে তার সঙ্গে আর কোন গণহত্যার তুলনা চলে না। গণহত্যার শিকার মানুষের রক্তের দাগ কখনোই এ দেশের মাটি থেকে মুছে যাবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করেছেন। আর তাই এ নৃশংস গণহত্যার বিচার অবশ্যই করতে হবে। আর তা করতে হলে ব্যাপক গবেষণা ও প্রচারণা করতে হবে। গণহত্যার অনেক প্রমাণ দেশে-বিদেশে রয়েছে। তাই এ বিচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার শতভাগ সুযোগ রয়েছে। অবশ্য গত ৪৬ বছরেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনরুদ্ধার সংরক্ষণ করতে পারিনি। শেখ হাসিনার সরকার মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রেখেছেন। ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোন দেশ সাহস দেখিয়ে গণহত্যার বিচার করতে পারেনি, যা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান জরুরী। যেখানে আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডির গণহত্যা স্বীকৃতি পেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ না পাবার কোন কারণ নেই। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগের। বাংলাদেশ এই দাবি জানিয়ে আসছে অবশ্য। ঢাকায় দুই দিনব্যাপী ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে এই দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করা হয়েছে। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট এই সেমিনারের আয়োজন করে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে অবশ্যই। সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী। এতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিসর, কম্বোডিয়া, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে, এটা প্রতিষ্ঠিত। তবে স্বীকৃত নয়, তাই এখন স্বীকৃতি দরকার। তাই একাত্তরের গণহত্যার বিশ্বস্বীকৃতি যেমন প্রয়োজন তেমনি গণহত্যার বিচার হওয়াও প্রয়োজন। আর এ দেশবাসী শুধু নয়, বিশ্বের বিবেকবান মানুষও তাই চায়।
×