ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশী মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে, দামও কমছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৮ নভেম্বর ২০১৭

দেশী মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে, দামও কমছে

এম শাহজাহান ॥ ঢাকার আড়তে আসতে শুরু করেছে মৌসুমের নতুন দেশী জাতের ‘মুড়িকাটা’ পেঁয়াজ। রবিবার মধ্যরাতে শ্যামবাজারের আড়তে এই পেঁয়াজের প্রথম চালান আসে পাবনার ঈশ্বরদী থেকে। প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৬৭-৬৮ টাকায়। ‘মুড়িকাটা’ খ্যাত ঈশ্বরদীর এই পেঁয়াজ এখন থেকে প্রতিদিনই আসবে রাজধানীর আড়ত ও পাইকারি বাজারে। আগামী দু’একদিনের মধ্যে খুচরা বাজার হয়ে ভোক্তার রান্না ঘর পর্যন্ত পৌঁছবে দেশীয় জাতের এই নতুন পেঁয়াজ। মুড়িকাটা পেঁয়াজের সরবরাহের কারণে আড়ত ও পাইকারি বাজারে দাম পড়তে শুরু করেছে। দেশীয় জাতের পুরনো পেঁয়াজের প্রতিকেজিতে দাম কমেছে তিন থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। দাম কিছুটা কমে খুচরা বাজারে দেশীয় জাতের পেঁয়াজ ৯০-৯৫ এবং আমদানিকৃতটি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়। রাজধানীর শ্যামবাজারের আড়ত, পাইকারি বাজার এবং খুচরা বাজার ঘুরে পেঁয়াজের দরদামের এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ভারতের রফতানিমূল্য বাড়ানোর খবরে দেশে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে আড়ত ও পাইকারি বাজারে। ওই দরে পেঁয়াজ বাংলাদেশে আসার আগেই দেশের ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে খুচরা বাজারে হঠাৎ করে প্রতিকেজি পেঁয়াজে দাম বাড়ে প্রায় ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত। রবিবার পর্যন্ত দামের উর্ধগতি থাকলেও সোমবারে নতুন করে আর দাম বাড়েনি। দাম বৃদ্ধির পেছনে কৃত্রিম সঙ্কটই দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত বছর এই সময়ে বাজারে পেঁয়াজের দর কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৪০ টাকা ছিল। আর এবার তা বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকায়। এদিকে, পেঁয়াজসহ কয়েকটি মসলা জাতীয় পণ্যের দাম সম্প্রতি বেপরোয়া গতিতে বেড়েছে বলে মনে করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হিসেবে করে দেখেছে, বাংলাদেশে বর্তমান যে মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে তা আমদানি মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এতে করে সাধারণ ভোক্তাদের অস্বস্তি ও কষ্ট বেড়েছে। পেঁয়াজের এই সঙ্কট সৃষ্টির জন্য শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতে রফতানি মূল্য বাড়ানো হলেও সঙ্গে সঙ্গে তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার কথা নয়। কারণ আগের দামের ‘এলসিকৃত’ পেঁয়াজ এখনও আসছে। এছাড়া বাজারে পেঁয়াজের কোন সঙ্কট নেই। দেশীয় মজুদকৃত পেঁয়াজ ও আমদানিকৃতটির সরবরাহ পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। এরপরও কেন পেঁয়াজের দাম বাড়াল সে বিষয়ে খোঁজখবর ও করণীয় নির্ধারণে আজ মঙ্গলবার বিকেল তিনটায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। এই সভায় পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ছে, এর পেছনে কারা দায়ী সেসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে। পেঁয়াজের দাম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠকে বলেন, পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, তবে আর যাতে না বাড়ে সেজন্য আমরা কিছু পদক্ষেপ নেব। তিনি বলেন, মৌসুমের নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে, তাই দাম বাড়ার আর কোন সুযোগ নেই। পণ্যটির প্রধান উৎস ও সরবরাহকারী দেশ ভারতে এবার বন্যা ও বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া দেশেও এবছর ভারিবর্ষণ ও বন্যা হয়েছে। সব মিলিয়ে বাজার বেশ চড়া। তবে আমাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করায় শীঘ্রই দাম কমে আসবে। পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ॥ বাংলাদেশে কি পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এবং এ পণ্যটির চাহিদা কতটুকু তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। সঠিক তথ্য নিরূপণ না হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন সময়ে পেঁয়াজের বাজারে শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৬৬ হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে ১ লাখ ৩১ হাজার টন বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, আলোচ্য সময়ে দেশে ১০ লাখ ৪১ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে তিন লাখ ৪০ হাজার টন বেশি। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে পেঁয়াজের যোগান এসেছে ২৯ লাখ টন। গত মৌসুমে উৎপাদিত দেশী পেঁয়াজ এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্যামবাজারের মেসার্স সততা এন্টার প্রাইজের ব্যবস্থাপক শুভাস বসাক জনকণ্ঠকে বলেন, দেশীয় পেঁয়াজই মূল ভরসা। এতভাল মানের পেঁয়াজ বিশ্বের আর কোথাও উৎপাদন হয় না। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কিছুটা কম হওয়ায় দাম বেড়েছে। সর্বশেষ ভারতের রফতানি বন্ধের খবরে দাম আরও বেড়ে যায়। তবে বাজারে পেঁয়াজের কোন ঘাটতি নেই। পেঁয়াজ আছে। বিবিএসের ২০১৪ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, এক কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে গড়ে ১১ টাকা ৪৪ পয়সা খরচ হয়। দেশের অনেক চাষী ঘরের মাচায় পেঁয়াজ রেখে দেন, যা মৌসুম শেষে বিক্রি করেন। অনেক ফড়িয়া ব্যবসায়ীও পেঁয়াজ কিনে রাখেন লাভের আশায়। এদিকে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টন। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা আরও বেশি। এর একটি সঠিক পরিসংখ্যান থাকা উচিত। ভারতের রফতানিমূল্য বাড়ানোর প্রভাব ॥ ভারতের সংস্থা ডিরেক্টর জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) গত বৃহস্পতিবার এক প্রজ্ঞাপনে পেঁয়াজের ন্যূনতম রফতানিমূল্য ৮৫০ ডলার ঠিক করে দেয়। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশসহ অন্য দেশের আমদানিকারকেরা ভারত থেকে এর চেয়ে কম দামে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারবেন না। পেঁয়াজের এ ন্যূনতম রফতানিমূল্য ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে বলে জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দেশটির বিভিন্ন শহরে পেঁয়াজের কেজি ৫০-৬০ রুপীতে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম চড়ে গেলে ভারত পেঁয়াজের ন্যূনতম রফতানিমূল্য বেঁধে দেয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের শেষ দিকে দেশটি ন্যূনতম রফতানিমূল্য ৭০০ ডলার করেছিল, যা ওই বছরের ডিসেম্বরে তুলে নেয়া হয়। তবে ওই দরে পেঁয়াজ বাংলাদেশে আসার আগেই দেশের ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে কষ্ট বেড়েছে সাধারণ ভোক্তাদের। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে শ্যামবাজারের মেসার্স আলী ট্রেডার্সেও স্বত্বাধিকারী শামসুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমদানিকৃত ৯০ ভাগ পেঁয়াজ ভারত থেকে আসে। তাই ওখানে দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশে বাড়ানো হয়েছে। তিনি স্বীকার করে বলেন, এটা ঠিক হয়নি। ওই দাম কার্যকর এবং ওই দামে আমদানি করার আগে দেশে বাড়ানো ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খুচরা পর্যায়ে। পাইকারি বাজারে কেজিতে তিন-পাঁচ টাকা দাম কমলেও খুচরায় তার প্রভাব নেই। এটা একটি সমস্যাও বটে। স্থানীয় পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বাড়েনি ॥ স্থানীয় বা উৎপাদন পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বাড়েনি বলে সংশ্লিষ্টসূত্রগুলো জানিয়েছে। পাবনার ঈশ্বরদীতে নতুন পেঁয়াজ মুড়িকাটা উঠতে শুরু হয়েছে। এছাড়া ফরিদপুর অঞ্চলের মজুদকৃত পেঁয়াজ ছাড়া শুরু হয়েছে। শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সবচেয়ে ভালমানের ৪০ কেজির বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৮০০ টাকা। দেশের কোথাও কোথাও এই পেঁয়াজ তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে, তবে তা সামান্য সময়ের জন্য। এখন আবার দাম পড়তির দিকে রয়েছে।
×