ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আলম শাইন

অভিমত ॥ মাদকের থাবায় পথশিশু

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৮ নভেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ মাদকের থাবায় পথশিশু

সম্প্রতি খবরের কাগজের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা গেছে, ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ বাংলাদেশ’ (আইসিডিডিআরবি) ও বেসরকারি সংস্থা ‘মোস্ট এ্যাট রিস্ক এ্যাডোলেসেন্ট’ (এমএআরএ)-এর তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে মোট পথশিশুর সংখ্যা ৪ লাখ ৪৫ হাজার। তন্মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ৩ লাখের বেশি পথশিশু। যাদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। প্রায় ৪৪ ভাগ পথশিশু মাদক গ্রহণ ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। ৩৫ শতাংশ পথশিশু পিকেটিং এবং বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, যদিও হালে পিকেটিং ও বোমাবাজদের তৎপরতা নেই, তবে সামনে ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওরা তৎপর হতে পারে আবারও। যার জন্য আগাম সাবধানতার প্রয়োজন বোধ করছি আমরা। বাকি ২১ শতাংশ পথশিশু ছিনতাই ও আন্ডারগ্রাউন্ডের সন্ত্রাসীদের সোর্স হিসেবে কাজ করছে এবং অন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। জড়িত হচ্ছে ছিঁচকে চুরির সঙ্গেও। অপরদিকে ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, রাজধানীর ৮৫ শতাংশ পথশিশু কোন না কোন ধরনের মাদক গ্রহণের সঙ্গে জড়িত। আরেক পরিসংখ্যানে সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজধানীতে মাদকসেবীদের ২২৯টি স্পট রয়েছে। সে তথ্য মোতাবেক জানা যায়, রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, চানখাঁরপুল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বর, কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনালসহ অন্য স্থানে অবাধে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ঘুমের ওষুধসহ নানা ধরনের মাদক গ্রহণ করছে পথশিশুরা। সমীক্ষায় জানা যায়, পথশিশুদের মাদকাসক্ত হওয়ার মূল কারণ অবিভাবকত্বহীনতা। এ ছাড়াও দারিদ্র্যের অজুহাতে পথশিশুদের নামতে হয় উপার্জনের পথে। উপার্জনের হাতেখড়ি হয় পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ এবং বোতল বা প্লাস্টিক সামগ্রী সংগ্রহের মাধ্যমে। ফেলে দেয়া নানা সামগ্রী কুড়াতে গিয়ে এরা প্রথমে নেশার রাজ্যে পা রাখে। ভাঙ্গাড়ি দ্রব্যাদি কুড়াতে গিয়ে সাক্ষাত মেলে কোন মাদকসেবীর সঙ্গে। ওরা মাদক গ্রহণের পর অবশিষ্ট অংশটুকু বাড়িয়ে দেয় শিশুটির দিকে। আবার অনেক মাদক ব্যবসায়ী এদের খুঁজে বের করে একটু-আধটু নেশা জাতীয় সামগ্রী হাতে ধরিয়ে দেয়, শিখিয়ে দেয় ব্যবহার পদ্ধতিও। ব্যস্ উৎসুক শিশুদের শুরু হয়ে গেল নেশার রাজ্যে পদচারণা। নেশায় তাড়িত হয়ে শিশুরা তখন মাদক ব্যবসায়ীর কথায় ওঠবস করতে আরম্ভ করে। এ সুযোগে ওদের ময়লা-আবর্জনার ব্যাগে নেশা জাতীয় দ্রবাদি ঢুকিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে হুকুম করে। হুকুম তামিল করতে করতে একদিন পথশিশুরা হয়ে ওঠে তুখোড় নেশাখোর। যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোন পথ খোলা থাকে না ওদের। সমীক্ষায় জানা যায়, পথশিশুদের পরেই রাজধানীতে বেশি মাদকাসক্ত হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা। বাবার অগাধ অর্থ-কড়ি নাশের মোক্ষমস্থান হিসেবে বেছে নেয় এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসকে। অন্য স্থানের তুলনায় ক্যাম্পাস থাকে খানিকটা নিরাপদ। বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা খুব একটা বিরক্ত করার সুযোগ পায় না ক্যম্পাসে। ফলে ওরা বেপরোয়া হয়ে নেশায় আসক্ত হচ্ছে খুব সহজে। তৎসঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদেও। ইংলিশ মিড়িয়ামের শিক্ষার্থী মাদকসেবীরা ‘মডার্ন স্টুডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত। নেশা জাতীয় দ্রবাদির সঙ্গে জড়িত হতে না পারলে বন্ধুদের কাছে যেন ওদের মান থাকে না। ফলে বাধ্য হয়ে ভাল শিক্ষার্থীটিকেও ভিড়তে হয় নেশাখোরদের দলে। এতদস্থানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধু ছাত্রই নয়, ছাত্রীরাও সামান তালে এগিয়ে আছে। এদের বেশিরভাগই ইয়াবাসেবীর দলভুক্ত। কেউ কেউ গাঁজা, হুক্কা, হেরোইনসহ নানান জাতীয় নেশার চর্চাও করে। সেসব নেশা সামগ্রীর রয়েছে আবার আজব সব নাম। চিত্রটি তুলে ধরার পেছনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। নেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়। এ নিবন্ধ লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অবিভাবকদের সচেতন করা। কারণ অবিভাবকরা এখন অনেকটাই সন্তাননির্ভর হয়ে পড়েছেন। সন্তানের কথায় ওঠবস করাটাকে আভিজাত্য হিসেবে দেখছেন। কাড়িকাড়ি কড়ি সন্তানের হাতে তুলে দিতে না পারলে যেন তাদের স্বস্তি নেই। এ ধরনের অবিভাবকদের কল্যাণেই ‘ঐশী’র জন্ম হয়েছে। এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ঐশীকে তার মা-বাবার হন্তারক হতে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে নিজের মা-বাবা। মর্মন্তু‘দ এ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় দেশে সে জন্য সচেষ্ট হবেন নিশ্চয়ই বাবা-মায়েরা। সন্তানের প্রতি নিয়ম নজরদারি করবেন। ওদের সব আবদারে সাড়া না দিয়ে সংযত হওয়ার পরামর্শ দেবেন। তাতে বোধকরি উভয়ের কল্যাণ আসবে। লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশবিদ [email protected]
×