ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধীর দন্ড

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ২৮ নভেম্বর ২০১৭

যুদ্ধাপরাধীর দন্ড

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ পর্যন্ত হচ্ছে। বসনিয়া-হারজেগোবিনা যুদ্ধ শেষ হয়েছে সিকি শতক আগে। শুধু যুদ্ধ নয়, ব্যাপক গণহত্যার শিকার হয়েছিল দেশটির নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণ। যে যুদ্ধে পাইকারিভাবে মুসলিম পুরুষ ও ছেলেশিশুদের হত্যা করা হয়েছিল। ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বলকান অঞ্চলে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র? ১৯৯২ সালের মার্চে বসনিয়া স্বাধীন হবার পরপরই এখানে বসনিয়া, ক্রোয়েশীয় ও সার্বীয় জাতির মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধে। বসনিয়ার যুদ্ধকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধ। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালের এই একতরফা যুদ্ধে প্রায় এক লাখ মুসলিম নিহত হয়। বাস্তুচ্যুত হয় ২২ লাখ। কমিউনিস্ট শাসিত সাবেক যুগোস্লোভিয়া ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়ার দুই বছরের মাথায় এই যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে সার্ব ও ক্রোয়েট বাহিনী চরম বর্বরতার পরিচয় দেয়। সার্বিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসেভিচ ও বসনিয়ার সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ লাখো মানুষ হত্যা করে ইতিহাসে ঘৃণিত হয়ে আছেন। মিলোসেভিচ প্রয়াত হলেও বিচারের হাত থেকে রেহাই পাননি কারাদজিচ। ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৯৯৫-এর জুলাইয়ে স্রেব্রেনিৎসায় আট হাজারেরও বেশি বসনীয় যুবককে হত্যা করে সার্ববাহিনী। জাতিসংঘের হিসাবে বসনিয়ায় সার্ববাহিনী এক লাখের বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করে। দখলদার এই বাহিনীর ওপর ন্যাটোর বিমান হামলায় পিছু হটতে বাধ্য হয় দখলদার সার্বীয়রা। পালিয়ে যায় বসনিয়ার কুখ্যাত সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ। ওই গণহত্যাকালে সার্ব সামরিক প্রধান ছিলেন ‘বসনিয়ার কসাই’ খ্যাত রাতকো ম্লাদিচ। বসনিয়ার যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ সার্বিয়ার সীমান্তের কাছে অবস্থিত স্রেব্রেনিৎসাকে ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী ছিল নিরাপত্তায় নিয়োজিত। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই ম্লাদিচের বাহিনীর আচমকা আক্রমণে শান্তিরক্ষীরা আত্মসমর্পণ করে। সার্ববাহিনী এরপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে গণহত্যা চালায়, একই সঙ্গে ধর্ষণও। এই গণহত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে মামলা হয়। আদালত বসনিয়ার সার্ব নেতা কারাদিচকে ২০১৬ সালে চল্লিশ বছরের কারাদন্ড- প্রদান করে। আর বিচার চলাকালে ২০০৬ সালে কারাগারে মারা যান সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসেভিচ। আর ম্লাদিচের চার অধস্তনকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়। এ তালিকার সর্বশেষ সংযোজন ম্লাদিচকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয় এ সপ্তাহে। ৭৪ বছর বয়সী এই সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল এগারোটি। ২০১১ সালে গ্রেফতারের পর বিচারকাজ শুরু হয়। সব ক’টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আদালত বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো ও কসোভোর ১৬১ জনের বিচার করেছে। যার মধ্যে ৮৩ জনই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। যাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে সার্ব। ৭৪ বছর বয়সী বসনিয়ার কসাইয়ের শেষ দিনগুলো কারাগারের অন্ধকারেই কাটবে। এই বিচারের মধ্য দিয়ে আদালতের কার্যক্রমও শেষ হয়েছে। এই অঞ্চলে জাতিগত বিভক্তি প্রতিদিন বাড়ছে। বসনিয়ার সার্ব রাজনীতিকরা এখনও বিশ্বাস করেন, এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রোণোদিত, সার্বদের প্রতি ঐতিহাসিক অন্যায়। এই রায়ে তাদের মনোভাব বদলাবে না। গণহত্যায় যারা জড়িত তাদের সমর্থকরাই রাষ্ট্র পরিচালনায়। তাই সার্বরা ওই সময় যা করেছে তাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে মনেই করে না। দেশে দেশে মানুষ মানুষকে হত্যা করে ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতির নামে। শুধু বসনিয়া ও সার্বিয়ায় নয়, গণহত্যা হয়েছে এই বাংলাদেশে একাত্তরে। যে হত্যাযজ্ঞের বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। অনেকের রায় কার্যকরও হয়েছে। মিয়ানমারে বর্তমানে যা চলছে তা গণহত্যা। মানবতাবিরোধী হিসাবে হত্যাযজ্ঞেরও বিচার হবেই একদিন।
×