ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিসিএস শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে অচল সরকারী কলেজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৭ নভেম্বর ২০১৭

বিসিএস শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে  অচল সরকারী কলেজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বেসরকারী থেকে সরকারী হওয়া কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে শিক্ষক- কর্মকর্তাদের কর্মবিরতিতে অচল হলো সারাদেশের সকল সরকারী কলেজসহ সংশ্লিষ্ট দফতর। ক্লাস ও পরীক্ষা হয়নি সরকারী কলেজের কোথাও। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ডাকে দুদিনের কর্মবিরতির প্রথম দিন রবিবার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন সরকারী কলেজ, শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা। দেশজুড়ে পালিত কর্মবিরতি থেকে আরও বৃহত্তর কর্মসূচীর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষকরা। আজও চলবে কর্মসূচী। নতুন জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না করা, জাতীয়করণ শিক্ষকদের নিয়োগ বিধিমালা ও প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নের দাবিতে দুই দিনব্যাপী কর্মবিরতি পালন করছেন বিসিএস ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকরা। ‘নো বিসিএস নো ক্যাডার’ এ স্লোগান নিয়ে বিসিএস শিক্ষকদের কর্মবিরতি পালনের ফলে রবিবার দেশের সব সরকারী কলেজ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), সব শিক্ষা বোর্ড, সরকারী টিচার্স টেনিং কলেজসহ শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত সব প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও কাজ বন্ধ ছিল। বিভিন্ন কলেজ ঘুরে দেখা গেছে শিক্ষকদের এ কর্মসূচী পালনের কারণে সরকারী কলেজ খোলা থাকলেও পাঠদান ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। নিজ নিজ কলেজের সামনে শিক্ষকরা সারিবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। দাবি আদায়ে আবারও আগামী ৬ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা তিন দিনের কর্মবিরতি পালন করবেন শিক্ষকরা। কর্মবিরতিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকরা বলেন, জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের যদি শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করে আত্তীকরণ করা হয় তাহলে লাগাতার অনশন কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়া হবে। জাতীয়করণ শিক্ষকদের শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি মেনে নেবে না। তারা আরও বলেন, ক্যাডারবহির্ভূত রেখেই জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের সরকারী চাকরিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রয়েছে। তাই কোনভাবেই তাদের ক্যাডারভুক্তের সুযোগ নেই। পূর্ব ঘোষণা অনুসারে একযোগে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ডাকে এ কর্মসূচী পালিত হয়েছে। কর্মসূচী সফল করায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার ও মহাসচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরী বিসিএস ক্যাডারভুক্ত সারাদেশের সরকারী কলেজ শিক্ষকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, আমরা কলেজ জাতীয়করণের বিপক্ষে না। কিন্তু জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে তাদের ক্যাডারভুক্ত করা যাবে না। শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী কলেজ জাতীয়করণের পর নিয়োগ করা শিক্ষকদের জন্য নতুন বিধিমালা করতে হবে। জাতীয়করণের এ সমস্যার ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে, শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা চাই নতুন নিয়োগকৃত শিক্ষকদের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক। জাতীয়করণ করা কলেজের নন ক্যাডার শিক্ষকদের নিজ নিজ কলেজ থেকে অন্যত্র বদলি না করার আহ্বানও জানান নেতারা। শিক্ষক নেতারা আরও বলেন, বেসরকারী থেকে জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য পৃথক নিয়োগ, পদায়ন জ্যেষ্ঠতা, পদোন্নতি ও পরিচালনাসহ চাকরির শর্ত নির্ধারণ করে নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার, যাতে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে যোগদান করা কর্মকর্তাদের স্বার্থ ও মর্যাদা কোনভাবেই ক্ষুণœ না হয়। কিন্তু বেসরকারী কলেজের শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করার পাঁয়তারা চলছে। এখন জাতীয়করণ হওয়া শিক্ষকেরা যদি সরাসরি ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হন, তাহলে বিদ্যমান বিসিএস শিক্ষক ক্যাডারের কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠতা হারাবেন। এর ফলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের মেধাবী শিক্ষকেরাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেছেন, কলেজ জাতীয়করণ হোক তাতে আমাদের কোন সমস্যা নেই। আমরা কেউ জাতীয়করণের বিরুদ্ধে না। বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা আমাদের মতো দিলেও আপত্তি নেই। আমাদের দাবি, ওইসব শিক্ষককে নন-ক্যাডার মর্যাদায় রাখতে হবে, তাদের বদলি করা যাবে না এবং পদোন্নতির পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন বাস্তবায়ন করারও দাবি জানান। এ শিক্ষক নেতা আরও বলেন, বিসিএস শিক্ষা সমিতির মর্যাদা ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। তাই কোনভাবেই জাতীয়করণ হওয়া সাধারণ কলেজ শিক্ষকদের তাদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এ দাবিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জানুয়ারি মাসেও ৩ দিনের পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করা হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ও জাতীয় শিক্ষানীতির বাইরে কিছু করা হলে লাগাতার কর্মসূচী দেয়া হবে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি মহাসচিব মোঃ শাহেদুল কবির চৌধুরী বলেন, বিধিমালা জারি না করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন এবং জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে আমাদের যে রিক্রুটমেন্ট রুলস-১৯৮১ এবং ক্যাডার কম্পোজিশন রুলস-১৯৮০ আছে তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন কলেজকে জাতীয়করণ বা সরকারীকরণ যা-ই করা হোক না কেন কর্মবিরতি চলবে। আমরা কলেজ জাতীয়করণের বিপক্ষে না। কিন্তু জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে তাদের ক্যাডারভুক্ত করা যাবে না। শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী কলেজ জাতীয়করণের পর নিয়োগ করা শিক্ষকদের জন্য নতুন বিধিমালা করতে হবে। এদিকে দেশের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন মহলের দাবির পরও যোগ্যতার বিচারের প্রশ্নবিদ্ধ বেসরকারী শিক্ষকদের ‘বিসিএস ক্যাডার’ করার উদ্যোগে অস্থিরতার দিকেই যাচ্ছে শিক্ষাঙ্গন। দ্রুত এ সঙ্কটের সমাধান না করা হলে কলেজগুলোতে পাঠদান বিঘিœত হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। বিসিএস শিক্ষা সমিতির নেতা ড. আবদুল কুদ্দুস সিকদারও তাদের কর্মসূচী তুলে ধরে বলছিলেন, আমরা কলেজ জাতীয়করণের বিপক্ষে না। কিন্তু জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে তাদের ক্যাডারভুক্ত করা যাবে না। শিক্ষানীতি অনুযায়ী কলেজ জাতীয়করণের পর ওই কলেজের শিক্ষকদের জন্য নতুন বিধিমালা করতে হবে। একজন ব্যক্তি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। আরেকজন মেধার পরিচয় দিয়ে বিসিএস পাস করেছেন। এই দুজনকে এক করলে বিসিএস পরীক্ষার কোন মানে থাকে না। আশাকরি সরকার বিষয়টি বুঝবে। বিসিএস ছাড়া ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করলে শুধু শিক্ষা ক্যাডারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। শিক্ষা ব্যবস্থাসহ গোটা দেশের জন্যই হবে এটা ভয়ানক ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত। এদিকে বিসিএস পরীক্ষা ছাড়াই বিসিএস ক্যাডার করার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। রাজিব নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘শিক্ষার মান উন্নয়ন আগে হওয়া উচিত। মুড়ি মুড়কি একদর হলে এই উন্নয়ন কমবে বৈ বাড়বে না। বিসিএস ছাড়াই যদি প্রজাতন্ত্রের ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগ দেয়া যায় তবে পিএসসির মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কী প্রয়োজন? ঘড় ইঈঝ ঘড় ঈধফৎব -এ দাবিটি তো খুবই যৌক্তিক’। হাসনাহেনা লিখেছেন, ‘আসলে দেশটা এক জগাখিচুড়ী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। কোন কিছুরই সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি নাই। বিসিএস এবং নো বিসিএসের মধ্যে পার্থক্যই যদি না থাকে, তাহলে বিসিএস প্রথা কেন চালু আছে? আর পার্থক্য যদি থেকেই থাকে, সেই পার্থক্য ক্ষেত্র বিশেষে কার্যত মানা হবে না কেন? গাধা-ঘোড়ার তো একদাম হতে পারে না! কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ বা সরকারীকরণের ‘ক্রাইটেরিয়া’ কি? কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারীকরণ করতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। এসব জগাখিচুড়ির মাশুল গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের তথা দেশবাসীকে। এই জগাখিচুড়ি আর কতদিন ...?
×