ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৫২ আসামির মৃত্যুদন্ড অনুমোদন ও আপীলের রায় পড়া শুরু

বিডিআর বিদ্রোহ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৭ নভেম্বর ২০১৭

বিডিআর বিদ্রোহ

বিকাশ দত্ত ॥ বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় ১৫২ আসামির মৃত্যুদন্ডের অনুমোদন ও আসামিদের আপীলের রায় পড়া অব্যাহত রয়েছে। এ মামলায় পর্যবেক্ষণসহ রায় ঘোষণা করছে হাইকোর্ট। আজ সোমবার পূর্ণাঙ্গ রায় পড়া শেষ হবে বলে জানিয়েছেন তিন সদস্যের বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি। রবিবার সকাল ১০টা ৫৫ মিনিট থেকে বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) হাইকোর্ট বেঞ্চ আলোচিত হত্যা মামলাটির রায় পড়া শুরু করেন। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেনÑ বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার। এদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, পিলখানা হত্যা মামলায় ক’জন আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল থাকবে, ক’জন আসামির যাবজ্জীবন বহাল থাকবে এবং ক’জন খালাস পাবেন- এসব ব্যাপারে বিচারপতিগণ একমত হয়েছেন বলে আদালত জানিয়েছেন। এই মামলায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শুনানি হয়েছে। রবিবার এই মামলার রায় পড়ছে আদালত। পূর্ণাঙ্গ রায় যদি পড়া হয়, তাহলে সময় লাগতে পারে। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিকাল ৪টায় বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেন বলেন, বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী তার রায়ের অংশ পড়া শেষ করেছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় আবার আদালত বসবে এবং বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরবেন। ‘আশা করি, আগামীকাল (সোমবার) দুপুরের আগেই আমরা মূল রায় দেয়া শুরু করতে পারব।’ বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী তার হাজার পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণের সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনান। তিনি বলেন, পিলখানা হত্যা মামলার ১০ হাজার পৃষ্ঠার রায় পড়তে কয়েক দিন সময় লাগবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘শেখ হাসিনার নব গঠিত সরকারকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করতে এবং বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এই বিদ্রোহ ঘটানো হয়।’ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় যৌক্তিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। মাত্র ৩০ ঘণ্টার ব্যবধানে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন, নৃশংস এবং বর্বরোচিত ঘটনা। এ হত্যাকান্ড আমরা আমাদের সূর্যসন্তানদের হারিয়েছি। ‘এ এক নৃশংস, বর্বরোচিত হত্যাকান্ড। এ মামলাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানী, আইন বিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের গবেষণা, অপরাধের ধরন, কারণ ও পবিত্র কোরান শরীফের কিছু নির্দেশনাসহ বেশ কিছু ধর্মগ্রন্থের পর্যালোচনা করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করে আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিদ্রোহের সেই সময়কার ঘটনাগুলোর বর্ণনা করার পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্কের শুনানি তুলে ধরা হয়েছে। পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় করা হত্যা মামলায় আসামিদের মৃত্যুদ-ের অনুমোদন চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন এবং আসামিপক্ষের খালাস চেয়ে করা হাইকোর্টে আপীলের রায়ে এ কথা বলা হয়েছে। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন ৫৫ সেনা। ১৯৬৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ৭ দিনের বিদ্রোহে মারা গিয়েছিলেন ১০০ জন, আফ্রিকায় মারা যান ১৭ জন। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘এই রায়ে প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার বেশি অবজারভেশন (পর্যবেক্ষণ) দেব। রায়টি সব মিলিয়ে ১০ হাজার পৃষ্ঠার বেশি। রায় পুরো পড়ব না। তবে পুরো পর্যবেক্ষণটি আমরা পড়ে শোনাব। পূর্ণ পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা সামারিলি জাজমেন্ট (সংক্ষিপ্ত রায়) দেব। সেখানে রায়ের ফাউন্ডেশন (মূল ভিত্তি) অংশকে কোন্ কারণে কী সাজা পেয়েছেন তা আমরা উল্লেখ করব। এ কারণে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।’ ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এত অল্প সময়ে ৫৭ সেনাকে হত্যার ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি। এই রায় ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী। ইতিহাসের জঘন্যতম ও বর্বরোচিত এই হত্যাকান্ড ঘটাতে অমানবিক নির্যাতন, অস্ত্র লুণ্ঠনের মতো ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার মাধ্যমে জনমনে ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়।’ আদালত পর্যবেক্ষণে বলে, ‘আমরা বারবার বিস্মিত হয়েছি এ জন্য যে, বিডিআর একাত্তর সালে সীমান্ত রক্ষায় প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ইতিহাসের সেই ঐতিহাসিক অর্জনকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশের আইনের শাসন বিনষ্ট করতে এক কলঙ্কের চিত্র বহন করতে হবে।’ আদালত বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন ইপিআর পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সীমান্তরক্ষায় নিয়োজিত এই বাহিনী দেশে-বিদেশে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে পিলখানায় তৎকালীন বিডিআরের কিছু সদস্য আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন। এই কলঙ্কচিহ্ন তাদের অনেক দিন বয়ে বেড়াতে হবে। একসঙ্গে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার নজির ইতিহাসে নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌক্তিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। নিরাপত্তা জোরদার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের মূল গেট, বার কাউন্সিলের পাশের গেট এবং হাইকোর্ট মাজার গেটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে হাইকোর্ট মাজার গেট পর্যন্ত সড়কেও মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশের পুরুষ এবং নারী সদস্য। সুপ্রীমকোর্টের মূল গেটে আর্চওয়ে গেট বসিয়ে আইনজীবী ও আসামির স্বজনদের ভেতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে। গাড়িগুলোতেও করা হচ্ছে তল্লাশি। এ্যানেক্স ভবনের ২৪ নম্বর কক্ষের বাইরেও নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জেরাদার করা হয়েছে। আইডি কার্ড দেখে পরিচয় নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। দ-ের বিষয়ে তিন বিচারপতিই একমত’ এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যা মামলায় কয়জন আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল থাকবে, কয়জন আসামির যাবজ্জীবন বহাল থাকবে, কতজন খালাস পাবেন এসব দন্ডের বিষয়ে তিন বিচারপতিই একমত হয়েছেন বলে আদালত জানিয়েছেন। পিলখানা হত্যা মামলার রায় নিয়ে রবিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সে সময় তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান। আদালতের রায় ঘোষণা শুরু করার আগেই বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেন উপস্থিত আইনজীবী ও সাংবাদিকদের জানান, ন্যক্কারজনক ও নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনায় রায়ের বিষয়ে আমরা তিন বিচারপতি একমত। মাহবুবে আলম জানান, পূর্ণাঙ্গ রায় যদি পড়া হয়, তাহলে সময় লাগতে পারে। আজ (রবিবার) হয়তো আসামিদের অর্ডার পোরশন (আদেশের অংশ) দেয়া হবে। আসামির চূড়ান্ত রায় হবে বলে মনে হয় না। যেসব আসামির দন্ড বহাল থাকবে বা খালাস পাবেন, কী কারণে দন্ড বহাল থাকল বা খালাস হলো, তার পর্যবেক্ষণ ও যুক্তি আদালত তুলে ধরবে। এ রায় মোট কত পৃষ্ঠার, তা পূর্ণাঙ্গ রায় না হলে বলা যাবে না। এ মামলাটি পৃথিবীর ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য একটি মামলা ।
×