ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারতীয় তীরন্দাজ দীপিকা কুমারীর স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৬ নভেম্বর ২০১৭

ভারতীয় তীরন্দাজ দীপিকা কুমারীর স্বপ্ন

রুমেল খান ॥ ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি ও ৫৬ কেজির অধিকারী এক কৃষ্ণকলি। হাসিটা চমৎকার। হাসলে গালে টোল পড়ে। দেখতে বড়ই মায়াবতী। মেয়েটির নাম দীপিকা। না, বলিউড নায়িকা দীপিকা পাদুকোন নয়। তবে তাকে আরচারির নায়িকা বলা যেতেই পারে। পুরো নাম দীপিকা কুমারী। ভারতের ঝাড়খন্ডের রাঁচির রাতু চাতি গ্রাম। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা শিবনারায়ণ মাহাতো অটোরিকশা চালক। মা গীতা মাহাতো রাঁচি মেডিক্যাল কলেজের নার্স। আর্থিক টানাপোড়েন লেগেই আছে। তাদের একমাত্র মেয়ে দীপিকা। দারুণ দুরন্ত। শৈশবে পাথরের টুকরো দিয়ে আম পাড়তো। এই লক্ষ্যভেদ করার দক্ষতাই তাকে পরবর্তীতে তীরন্দাজ হিসেবে গড়ে তোলে। তবে দীপিকার তীরন্দাজ হওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তার মা-বাবাকে। কেননা আরচারির সরঞ্জামের অনেক দাম। এগুলো কিনতে হিমশিম খেতে হতো মাহাতো দম্পত্তিকে। তারপরও মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য কষ্ট করে গেছেন তারা। একসময় ঘরে তৈরি বাঁশের তীর দিয়ে আরচারি অনুশীলন করতে হয়েছে দিপীকাকে! তারপরও দমে যায়নি সে। ১৯৯৪ সালের ১৩ জুন জন্ম নেয়া দীপিকার বাবা-মায়ের এখন আর কোন আর্থিক সঙ্কট নেই। নেই তাদের মেয়ের জন্যই। কেননা দীপিকা এখন ভাল বেতনে চাকরি করে টাটা স্টিলে। চাকরি বলতে মাঝে মাঝে অফিসে গিয়ে হাজিরা দেয়া আর মাস শেষে বেতন তোলা। তার মূল কাজ হচ্ছে দেশে-বিদেশে ঘুরে ঘুরে আরচারি খেলা। দীপিকা যে অনেকদূর যাবে সেটা টের পেয়েছিলেন বাংলাদেশের আরচারি কোচ জিয়াউল হক, ‘ওকে প্রথম দেখি ২০০৯ সালে, কলকাতায়, একটি আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে। তবে আরচার হিসেবে নয়, একটি দলের (ভুটান) প্ল্যাকার্ড বহনকারী হিসেবে। তখন মেয়েটির মাঝে কিছু আরচারসুলভ গুণাবলী দেখেছিলাম। যেমন ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি। কয়েক বছরের মধ্যেই সে যখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সাফল্য পেতে শুরু করলো, তখন এই ভেবে খুশি হয়েছিলামÑ আমার ধারণাই সঠিক ছিল।’ তিনি আরও যোগ করেন, ওর শারীরিক গঠন আরচারির উপযোগী। মানসিকভাবেও খুবই আত্মবিশ্বাসী। এটাই ওর প্লাস পয়েন্ট।’ কেমন সঠিক ছিল, তার একটি নমুনা দেখা যাক। এ পর্যন্ত আরচারিতে অসামান্য অবদানের জন্য দীপিকা লাভ করেছে চারটি পুরস্কার। এগুলো হলোÑ ক্রীড়াক্ষেত্রে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্জুন পুরস্কার (২০১২ সালে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে), এফআইসিসিআই পুরস্কার (২০১৬), পদ্মশ্রী পুরস্কার (২০১৬) এবং ইয়াং এচিভার্স এ্যাওয়ার্ড (২০১৭)। ২০১২ সালে বিশ্বের এক নম্বর মহিলা আরচার (রিকার্ভ) দীপিকা বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম র‌্যাঙ্কিংধারী আরচার। তিনি এখন বাংলাদেশে। লক্ষ্য ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে রিকার্ভে এককে ও দলগত স্বর্ণপদক অর্জন করা। দীপিকা হচ্ছেন দ্বিতীয় ভারতীয় আরচার যিনি পালতোন হান্সদার পর (২০০৬, মেক্সিকো) বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জুনিয়র কম্পাউন্ড এককে স্বর্ণপদক জেতেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০১১ ও ২০১৫ আসরে দলগত রৌপ্য, বিশ্বকাপে ২০১১, ২০১২, ২০১৩ আসরে এককে রৌপ্য, ২০১০ কমনওয়েলথ গেমসে এককে ও দলগত ইভেন্টে স্বর্ণ, এশিয়ান গেমসে ২০১০ আসরে রিকার্ভে দলগত তাম্রপদক জিতেছেন দীপিকা। এছাড়া ২০০৯ ক্যাডেট বিশ্ব সাব-জুনিয়র এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ, ২০১০ এসএ গেমসে রিকার্ভে একক ও দলগত স্বর্ণ, ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্ব আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে এককে ও দলগত স্বর্ণ এবং ২০১৫ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে দলগত তাম্রপদক জিতেছেন তিনি। এ পর্যন্ত জিতেছেন দুটি অলিম্পিক গেমস। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেন। কারণ ছিল জ¦র এবং প্রচুর বাতাস। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট ছিলেন। ২০০৫ সালে অর্জুন আরচারি একাডেমিতে ভর্তি হয়ে ক্যারিয়ার শুরু দীপিকার। ২০০৮ কলকাতায় ট্রায়াল দিয়ে ওই বছরের জানুয়ারিতে জামশেদপুরের টাটা একাডেমিতে ভর্তি হন। ভাল পারফর্মেন্সের জন্য মাসিক ৫০০ রুপী করে বৃত্তি পেতেন তিনি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে এলেন দীপিকা। ঝাড়খ-ের মেয়ে তিনি। ওখানেই ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনির বাসা। বেশ কয়েকবারই ধোনির সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে। তারপরও ক্রিকেটার না হয়ে আরচারি বেছে নিলেন কেন? ‘আরচারি একক খেলা। তাই।’ দীপিকার সাবলীল জবাব। ঢাকায় টার্গেট কী? ‘অবশ্যই স্বর্ণপদক জয়। শুধু তাই নয়, ২০২০ টোকিও অলিম্পিকেও স্বর্ণপদক জয় আমার লক্ষ্য।’ দৃঢ়প্রত্যয়ী দেখাল দীপিকাকে। তার লক্ষ্য পূরণ হবে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।
×