ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘পার্বত্য চুক্তির ২০ বছর’ শীর্ষক পর্যালোচনায় বক্তাদের তথ্য

ভিটেছাড়া পাহাড়ীদের কোন সম্পত্তি নেই, চলছে জবরদখল

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২৬ নভেম্বর ২০১৭

ভিটেছাড়া পাহাড়ীদের কোন সম্পত্তি নেই, চলছে জবরদখল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তায়ম্যূ চাকমা এখন নিঃস্ব। বছরের পর বছর নিজের জমি ভেবে যেস্থানে তিনি জুম চাষ করেছেন সে জমিতে তার কোন অধিকার নেই। শুধু নিজের ভিটেবাড়ির জায়গাটুকু ছাড়া তার কোন সম্পত্তি নেই। বাধ্য হয়েই চাষাবাদ বন্ধ করে পরিবারের খাবার যোগাড়ের জন্য শহরে এসে অন্য কাজ খুঁজতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একই সমস্যায় জর্জরিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ঝিমিত চাকমা। এই উদ্যমী নারীর মৌজাবন ছিল বেশ খানিকটা পাহাড়জুড়ে। পরিবারে ছিল সচ্ছ্বলতা। বর্তমানে প্রশাসনের দখলে তার সেই মৌজাবন। ভূমিতে নেই অধিকার, সে সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক কাজও করতে পারছে না। এছাড়া প্রশাসনিক বিভিন্ন কর্মকা-ে তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন। পরবর্তীতে এলাকার ডিসির কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলেও তার কথায় আমল দেয়া হয়নি। পেটের তাগিদে ঝিমিত এখন শহরমুখী। শহরের একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন। আদিবাসী পাহাড়ীদের জমিজমা এখনও সেটেলার বাঙালীদের জবরদখলে। পক্ষান্তরে চুক্তি স্বাক্ষরের পরও চলছে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সেটেলার বাঙালীদের ভূমি জবরদখল। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বিগত ২০ বছরে চুক্তির ৩৩ কার্যাবলীর মধ্যে পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ এবং বরোটি চুক্তির মাধ্যমে আংশিকভাবে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরিত হয়েছে। এবং অবশিষ্ট ষোলোটি হস্তান্তরিত হয়নি। সম্প্রতি, সিএইচটি কমিশন ও এ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) যৌথ উদ্যোগে ‘পার্বত্য চুক্তির বিশ বছর’ শীর্ষক একটি পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে পার্বত্যবাসীর ভূমি অধিকার ও সমস্যা সমাধান শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ পর্যলোচনা তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী, ভূমি অধিকার নেতা-নেত্রী ও গবেষকসহ নাগরিক সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিএইচটি কমিশনের কো-চেয়ার সুলতানা কামাল। ‘পার্বত্য চুক্তির বিশ বছর’ শীর্ষক পর্যালোচনায় দেখা যায়, চুক্তি অনুযায়ী ৯ হাজার ৭৮০ ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী পরিবার কর্তৃক তাদের জায়গাজমির আংশিক বা সম্পূর্ণ ফেরত পাওয়া, রবার বা অন্যান্য প্লান্টেশনের বাতিলকৃত পাঁচ শতাধিক প্লটের মধ্যে তিন শতাধিক প্লটের ইজারা পুনর্বহাল, সরকারী চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় কোটার পূর্ণ বরাদ্দ, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী,আধাসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ও স্থায়ী বাসিন্দাকে নিয়োগসহ ইত্যাদি কার্যক্রম চলমান এবং এসব কার্যক্রমের আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। অন্যদিকে, চুক্তির অবাস্তবায়িত দিকের মধ্যে চুক্তির মূল বিষয় সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, ভূমি প্রশাসন, পৌরসভাসহ জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদের উন্নয়ন কাজের সমন্বয়ের কর্তৃত্ব জেলা পরিষদে ন্যস্ত হয়নি, স্থানীয় পুলিশ নিয়োগসহ পুলিশকে জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়নি, চুক্তি অনুসারে জেলা পুলিশকে জেলা পরিষদের নিকট দায়বদ্ধ করার কোন উদ্যোগ নেই ইত্যাদি। এছাড়া পর্যালোচনাপত্রে চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয় স্থানীয় পুলিশ নিয়োগসহ পুলিশকে জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত, চুক্তি অনুসারে জেলা পুলিশকে জেলা পরিষদের নিকট দায়বদ্ধ অভাব, পার্বত্য চট্টগ্রাম সঙ্কটের প্রেক্ষাপট এবং এর রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস সম্পর্কে সরকারের নির্বাহী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঠিক ধারণার অভাব, দেশের স্থিতিশীলতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখ-তার দোহাই দিয়ে চুক্তির বিরোধিতা করার প্রবণতা ইত্যাদি। গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক গৌতম দেওয়ান। পার্বত্য চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী পাহাড়ী-বাঙালী যাদের জায়গাজমি বন্দোবস্ত ও ভোগদখল রয়েছে তাদের অন্যায্যভাবে উচ্ছেদ হওয়া বা ভূমি অধিকার হারানোর কোন কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে, জবরদস্তি উপায়ে কিংবা পদ্ধতিবহির্ভূতভাবে জায়গাজমি বন্দোবস্তী নিয়েছেন বা বেদখল করেছেন তাদের তো আইনের আওতায় আসতেই হবে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে তো অবৈধ বন্দোবস্তী বা বেদখল ছেড়েই দিতে হবে। সেসব অবৈধ দখলদারের পক্ষে সাফাই গাওয়া কখনই মানবিক, ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক হতে পারে না। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বলেন, মিয়ানমারের গ-ি পেরিয়ে বাংলাদেশে আসা ১২ লাখ রোহিঙ্গার জায়গা দিতে গিয়ে অনেক পাহাড় এখন প্রায় অদৃশ্য। এরা পার্বত্য অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। এতে পার্বত্যবাসী আরও অসহায় হয়ে পড়ছে।
×