ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরবাসে শিশুর হাতে বাংলাদেশী খেলনা

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৬ নভেম্বর ২০১৭

পরবাসে শিশুর হাতে বাংলাদেশী খেলনা

বাংলাদেশের শহর-গ্রাম-মফস্বলে ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের হাতে যেসব স্বল্পমূল্যের প্লাস্টিক খেলনা বিক্রি হয় এক সময় সেগুলো ছিল সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। তবে পাল্টে গেছে চিত্র। বাজারে এখন হরহামেশা যে খেলনাগুলো দেখা যাচ্ছে তার অধিকাংশই বাংলাদেশে তৈরি। কয়েক বছর আগেও প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই আসত চীন থেকে। কিন্তু এখন সেই বাজারে ভাল একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশে তৈরি খেলনা। বর্তমান যুগে প্লাস্টিকের খেলনার বেশ চাহিদা রয়েছে। বাচ্চাদের খেলার জন্য প্লাস্টিক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনাসামগ্রী তৈরি করা হয়। তার মধ্যে- বল, পুতুল, গাড়ি, প্লেন, পিস্তল, সুপারম্যান, এক্স-বক্স, রঙিন বর্ণমালা, কাপড়ের তৈরি ছোট ছোট খেলনা কিংবা বিভিন্ন পশুপাখি, কিচেন সেট, বার্বি সেট, ডলস হাউস এবং মেকিং টয়সহ আরও নানা খেলনা। এসব খেলনা এক সময় চায়না থেকে আমদানি হতো। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশেও খেলনাগুলো তৈরি হচ্ছে। শুধু ছোটরা নয়, অনেক বড় মানুষের পছন্দের তালিকায় আছে অসংখ্য খেলনা। খেলনা এখন শুধু নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না, বিদ্যুত ও ব্যাটারিচালিত খেলনা এখন ছোটাছুটি করে সবাইকে আনন্দ দিয়ে চলছে। হাতি, ঘোড়া, বাঘ-ভল্লুক, বাস ও ট্রেন সব রকমের ‘জ্যান্ত’ খেলনাই বিজ্ঞানের কল্যাণে হাতের নাগালে। পুতুল, ইয়ো-ইয়ো, লাটিম, বল, বাঁশি, ঘুড়িসহ আরও কত রকমের খেলনা বিশ্বজুড়ে শিশুরা নাড়াচাড়া করে আসছে। এটা শুধু আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, সেই সঙ্গে পৃথিবী ও পরিবেশ সম্পর্কে শিশুদের জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে চলছে। খেলনা তাদের কল্পনাশক্তিকে উসকে দেয়, পেশি আর শরীর গঠনে দারুণ সহায়তা করে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রায় ৪ হাজার বছরের বেশি আগে মিসরে চাকা লাগানো খেলনা ব্যবহার করা হতো। আড়াই হাজার বছরের বেশি আগে চীনারা বিশ্বের প্রথম ঘুড়ি উড়িয়েছিল। ৫০০ বছরের বেশি আগে দক্ষিণ আমেরিকায় খেলনা হিসেবে রাবারের বল ব্যবহার করা হয়। আড়াই হাজার বছরের বেশি আগে চীন ও গ্রিসে ইয়ো-ইয়ো দিয়ে খেলা হতো। টাট্টু ঘোড়া শিশুদের খুবই প্রিয় একটি খেলনা। এটি বিশ্বের অনেক দেশে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ তৈরি করত তাদের শিশুদের আনন্দ দেয়ার জন্য। অনেকদিন আগে লোকেরা বিশ্বাস করত এই খেলনাগুলো শয়তানের প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করবে। লিখিত ভাষা উদ্ভাবনের অনেক আগেই মানুষ প্রায়ই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পাপেট অর্থাৎ নড়াচড়া করানো যায় এ রকম খেলনা পুতুল ব্যবহার করত। সম্ভবত পুতুলই ছিল দুনিয়ার আদি খেলনা। খেলনার কাছ থেকে আমরা অতীতের অনেক কিছু জানতে পারি। অতীতের পোশাক, রুচি, পরিবেশ ইত্যাদি সম্পর্কে সেকালের খেলনা থেকে অনেক ধারণা পাওয়া যায়। আশার কথা হলো আমাদের মোট চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ খেলনা এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশী খেলনা রফতানি বেড়েছে দুই হাজার গুণের বেশি। ৬ বছর আগে যেখানে বছরে মাত্র ৭ হাজার ডলারের মতো খেলনা রফতানি হতো, এখন তা বেড়ে দেড় কোটি ডলারে পৌঁছেছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ১২৬ কোটি টাকা। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী খেলনার চাহিদা সামনে রেখে অবশ্য খেলনা কারখানা নির্মাণে বিনিয়োগেও আগ্রহী হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তারা। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) এবং এর বাইরে বেশ কয়েকটি রফতানিমুখী খেলনার কারখানা গড়ে উঠেছে। খেলনার কাঁচামাল আমদানির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খেলনাশিল্পে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ মার্কিন ডলারের। এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির এ পরিমাণ পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ১৫০ ও ১০১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। আবার ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত খেলনা শিল্পে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৫ লাখ মার্কিন ডলারের। এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির এ পরিমাণ পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ৪৫০ ও ৪৪৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে খেলনা শিল্পে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয় ১ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার এবং নিষ্পত্তি হয় ৯০ হাজার মার্কিন ডলারের। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি ছিল। আমাদের দেশে প্রধানত ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হয়ে থাকে। প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরির কাঁচামাল তৈরি হয়ে থাকে পেট্রোলের বর্জ্য থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের টয় এ্যাসোসিয়েশনের হিসাবমতে, সারা বিশ্বে বছরে গড়ে ৯ হাজার কোটি ডলারের খেলনা বেচাকেনা হয়। বাংলাদেশের খেলনার রফতানিবাজার মূলত ইউরোপ ও জাপানকেন্দ্রিক। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ইউরোপের বাজারে বছরে গড়ে ৭২০ কোটি ডলারের খেলনা রফতানি হয়। খেলনা রফতানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে কর সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন ট্রাইসাইকেল, স্কুটার, প্যাডেল কার, পুতুল রফতানি করলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে আমদানি শুল্ক নেই। প্লাস্টিক ও ইলেক্ট্রনিক খেলনার ওপর ৪ দশমিক ৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক আছে। আর জাপানের বাজারে শুল্ক নেই। বাংলাদেশী খেলনা আমদানিতে শীর্ষ স্থানে আছে ফ্রান্স। দেশটি ওই বছর বাংলাদেশ থেকে ১৬ লাখ ডলারের খেলনা আমদানি করেছে। এরপরের স্থানে থাকা স্পেন নিয়েছে ১১ লাখ ৬৩ হাজার ডলারের খেলনা। আর জাপানে রফতানি হয়েছে ৯ লাখ ২৯ হাজার ডলারের খেলনা। বাংলাদেশ থেকে খেলনা আমদানির তালিকায় যেসব দেশ আছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাজ্য, ইতালি, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল। পাঁচ বছর আগেও এই তালিকা খুবই ছোট ছিল। ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র-মাত্র এই তিনটি দেশে খেলনা রফতানি হতো।
×