ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমঝোতা

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২৬ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমঝোতা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমঝোতা সই সঙ্কট নিরসনে প্রথম ধাপ। তবে রাখাইনের অন্ধকার দিগন্তে আলোর রুপালি রেখা কবে দেখা যাবে তা কেউ বলতে না পারলেও মিয়ানমার জানে সে কী করবে। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের পিতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার পথ মসৃণ নয়। দেশটির হানাদার সেনা ও তাদের সহযোগীরা ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, শিশু সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে গত তিন মাসে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। এই বর্বর নির্যাতনকে সারাবিশ্ব চরম অমানবিক নির্যাতন হিসেবেই দেখছে। জাতিসংঘ একে ‘জাতি নিধনের’ অপচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছে। অনেক বিশ্বনেতা সরাসরি একে গণহত্যা বলেছেন। তাই তারা নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন দফায় আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। বাস্তুচ্যুত এই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। এই উদ্যোগ বিশ্বে প্রশংসিত হলেও দীর্ঘ সময় ধরে এদের ভরণ-পোষণ করা বাংলাদেশের জন্য প্রায় অসম্ভব। মিয়ানমারের অতীত ও বর্তমান আচরণ যে মানবিক নয়, তা বিশ্ববাসী জানে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়নের যে পরিকল্পনা নিয়ে তাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী এমন বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে, তাতে দেশটির সরকার বা সেনাবাহিনী যে স্বেচ্ছায় তাদের ফিরিয়ে নিতে চাইবে তা অনেকেই বিশ্বাস করেন না। প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের কারণেই বলা যায়, তাদের উচ্চকণ্ঠ অনেকটা নিম্নকণ্ঠে পরিণত হচ্ছে। সুরও হয়েছে নরম। কতিপয় পরাক্রমশালী দেশ মিয়ানমারের ধনসম্পদ করায়ত্ত করার জন্যই বলা যায়, মিয়ানমারের বর্বরতাকে সয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বার বার চাপ প্রয়োগ সত্ত্বেও মিয়ানমার জাতিগত নিপীড়ন বন্ধ রাখেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র চাপ প্রয়োগ করলেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে। চালাকির যে পথ ও পন্থা তারা বেছে নিয়েছে, তাতে সমস্যার সমাধান সহজতর নয়। সর্বশেষ দেশটির রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ এশিয়া-ইউরোপ সভার (আসেম) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে মিয়ানমার বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় আগ্রহী হয়নি। তবে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো অবিলম্বে সংঘাত বন্ধ, রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের স্রোত থামানো এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দ্রুত ফিরিয়ে নেয়ার তাগিদ দিয়েছে। একই সঙ্গে তারা কোফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আউং সান সুচির অবস্থান ছিল কৌশলী। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুটি কার্যত এড়িয়ে গেলও বিশ্ববাসী অস্থিতিশীলতা, সংঘাত ও সন্ত্রাসের কারণ হিসেবে অবৈধ অভিবাসনকেই দায়ী করেছেন। জাতিগত নিধনযজ্ঞ নিয়ে বৈশ্বিক সমালোচনার কোন জবাব দেননি, তবে তার বক্তব্যে যে মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হলো মিয়ানমারের জনগণ রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী এবং সন্ত্রাসের জন্য দায়ী মনে করে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রোহিঙ্গা খেদাও ও নিপীড়নকে আড়াল করতে সুচি ও তার সহযোগীরা মিথ্যাচারকে সামনে আনছেন। বাংলাদেশ চায়, এই সমস্যার টেকসই সমাধান। তা নাহলে আজ আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে অতীতের মতো, কিন্তু কাল আবার নির্যাতনের মুখে তারা পালিয়ে আসবে। অবশেষে মিয়ানমরের কিছুটা হলেও বোধোদয় হয়েছে, তাই বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমঝোতা সই করেছে। এরপরও বিশ্ববাসী আশা করে মিয়ানমার ছলচাতুরীর আশ্রয় নেবে না। চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর করে আনান কমিশনের সুপারিশকে বাস্তবায়ন করবে। সমস্যার সমাধান মিয়ানমারের হাতেই। তাই তাকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে সার্বিক অর্থে।
×