ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গন্তব্যহীন যমজ খালেদ-খালেদা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

গন্তব্যহীন যমজ খালেদ-খালেদা

খালেদ আর খালেদা। দুই ভাই-বোন। যমজ। চরের শিশু। বয়স প্রায় আট বছর। দারিদ্র্য যেন এদের জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরেছে। পেটপুরে খাওয়া তো দূরের কথা জন্মের পর থেকে আজ অবধি স্যান্ডেল কিংবা জুতা পায় দেয়ার সাধ্য জোটেনি। খালি পায়ে থাকছে দিনভর। স্কুলে যাওযা-আসা করছেও খালি পায়ে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার প্রাক্কালে বাবা-মায়ের পুরনো, জোড়াতালির স্যান্ডেল নিয়ে পা ধুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নিজেরাও জানে না পায়ে স্যান্ডেল পরার সঙ্গতি আদৌ হবে কিনা। মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ছে। ওরা জীবনের জন্য বেড়ে উঠছে। নেই কোন গন্তব্য। যেন না জানা ভবিষ্যত। এইটুকুন বয়সে রয়েছে কিন্তু বিস্তর অভিজ্ঞতা। কখনও সাগরে মাছ ধরতে যায়। কখনও জ্বালানি সংগ্রহে গহীন জঙ্গলে। ভাগ্যে জোটেনি কোন সুখ-স্বচ্ছন্দ। তার পরও হাসছে মনখুলে। শুধু মায়ের কোল আগলে জন্মের পর থেকে ঘুমুনো, এটাই ওদের চরম পাওয়া। খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ওদের মৌলিক অধিকার। পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কেউ মৌলিক চাহিদার যোগান দেয়নি। খবরও নেয়নি কেউ। জোটেনি প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কোন ছায়া। ওরা এসব জানে না। বোঝেও না। গঙ্গামতির চরের শত ঘটনার এটি একটি। গল্প নয়, যেন গা শীতল করার সত্যকথন। যেন ভাবতেও অবাক লাগে। জন্মের পর থেকে অর্ধহার-অনাহার নিত্যঘটনা। সকালে পান্তা জুটলেও মরিচ আর নুন। দুপুরে কখনও জোটে। বহু রাতে পানি খেয়েই শেষ। মা আলেয়া বেগম সাগরের লোনা জলে কখনও চিংড়ি পোনা ধরছেন। কখনও কাটা আমনক্ষেতে পড়ে থাকা ধানের ছড়া কুড়িয়ে আনেন। সংসারে এমন সব উপার্জন। চিকচিকে কালো বর্ণের এই মা এখন আর কথায় কোন সম্বিত ফিরে পায় না। ওদের বাবা মজিবর থেকেও নেই। বয়সেও সায়াহ্ন। তার পরও অসুস্থ শরীরে কখনও পারলে কামলা দেন। কিন্তু একাধিক এনজিও সংস্থার কাছে এ পরিবারটি যেন তাদের পুঁজি। চার-পাঁচটি ক্ষুদ্র ঋণ রয়েছে। ওই জালে আটকে আছে। খালেদের ভাষ্য, ‘ভাই সালাউদ্দিন ক্লাস থ্রীতে পড়ে। আরেক ভাই ১২ বছরের সবুজ ক্লাস ওয়ানে। আরেক বোন পারভিন পড়ে না।’ যমজ খালেদ-খালেদা কেউ বলতে পারল না তারা কয় ভাই-বোন। তবে এই চরে ওদের আশ্রিতা খালু নুর ইসলাম জানালেন, ১১ সন্তানের এখন ছয়জন নিয়ে সংসার। এক সন্তান মালেক সিডরে ভেসে গেছে। লাশও জোটেনি। ঘরটিও ভেসে যায়। ফের একটি ছনের ঝুপড়িতে বসবাস। মাটির দেয়াল। ছিল সৈকতের বেলাভূমে। ত্রিশ বছরের বসতি এখানে। এক চিলতে জমির মালিকানাও জোটেনি। রাষ্ট্র কিংবা সরকারের সকল মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এ পরিবারটি। দুই যমজ খালেদ-খালেদার সঙ্গে কোন এক পড়ন্ত বিকেলে কথা হয়। ঝুপড়ি ঘরটির পেছন দিয়ে ধানক্ষেতের আইল পেরিয়ে পৌঁছতেই নিজের বানানো দেলনায় দুলছিল ছোট্ট খালেদা। আর খালেদ বোনটির সঙ্গে খুনসুটিতে মেতেছিল। -মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×