ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৫ বছরেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ

তাজরীনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন সবিতা, মানবেতর জীবন

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

তাজরীনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন সবিতা, মানবেতর জীবন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২০১২ সালের ২৪ নবেম্বর তাজরীন গার্মেন্টসের তৃতীয় তলায় কাজ করছিলাম। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফায়ার এলার্ম দেয়া সত্ত্বেও কাজ চলছিল। আগুন লাগার পর নিচে এসে দেখি গেটে তালা দেয়া। আগুন থেকে বাঁচতে ওপরে উঠতে অনেকের পায়ের নিচে পড়লাম। মনে হচ্ছিল মারা যাচ্ছি। একটা ছেলের শার্ট ধরে কোনভাবে প্রাণ বাঁচিয়েছি। কথাগুলে বলছিলেন তাজরীন ফ্যাশনে দুর্ঘটনার শিকার আহত শ্রমিক সবিতা রানী। তিনি আরও বলেন, এখন আমি মৃত জীবনযাপন করছি। শুয়ে শুয়ে দিন কাটে আমার। সারা শরীরে প্রচন্ড- ব্যথা। ঠিকভাবে হাঁটতে পারি না। আমার দায়িত্ব কে নেবে? আমার তিন মেয়েকে পড়াতে পারছি না। তাজরীন ট্র্যাজেডির ৫ বছর হলেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ। অন্যদিকে চিকিৎসা ভাতাও প্রায় বন্ধ বলে জানা গেছে। সবিতা রানীর মতো আরও অনেক শ্রমিক পাঁচ বছর ধরে তাজরীনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। অন্যের বোঝা হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তাদের জীবন। তাজরীন ট্র্যাজেডির ৫ বছর উপলক্ষে শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের উদ্যোগে তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকা-ে নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, সমাবেশ ও মিছিল করা হয়। এদিন সকাল ৯টা জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। এ ছাড়া সকাল ১১টায় প্রেসক্লাবের সামনে ‘সবার জন্য নিরাপদ কাজ চাই, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সবার যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন চাই’ এই স্লোগানে সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই তাজরীন দুর্ঘটনার শিকার কয়েকজন নারী শ্রমিকরা সেদিনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও বর্তমান জীবন সংগ্রামের কথা জনকণ্ঠকে জানান। আরেক নারী শ্রমিক আঞ্জুয়ারা বেগম ভয়াবহ সেই অগ্নিকা- থেকে প্রাণে বাঁচলেও জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকা থেকে এসে কাজ নিয়েছিলেন তাজরীন ফ্যাশনসে। আগুন থেকে বাঁচতে পাঁচ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন পাশের ভবনের ছাদে। কিন্তু সেখানে থাকা একটি লোহার টুকরো ডান পায়ে বিঁধে যায়। এছাড়াও কোমরে ও মাথায় প্রচ- আঘাত পান তিনি। আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে রিক্সাচালক স্বামীর সংসারে অভাবের কারণেই পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ নেই তাজরীন ফ্যাশনসে। কিন্তু আগুনের ঘটনা জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে।’ যে টাকা সহায়তা পেয়েছিলেন তা দিয়ে চিকিৎসা, খাওয়া, ঘরভাড়া দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। দুর্ঘটনার ৫ বছর পার হয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প শ্রমিক লীগের (বিটিজিডব্লিউএল) সভাপতি জেড. এম. কামরুল আনাম বলেন, ‘তাজরীন ট্র্যাজেডিতে ক্ষতিগ্রস্তদের বিজিএমইএ ও সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ছিল। এমনকি ১৩৮ জন নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। যাদের অনেকেই সেই অর্থ বুঝে পাননি। তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের আগে ৬ মাস অন্তর অন্তর চিকিৎসা ভাতা দেয়া হতো। সেটাও এখন অনিয়মিত, বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। অন্যদিকে সেদিনের দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করেছে যারা, তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এখনও সম্পন্ন হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা-পুনর্বাসনসহ নিরাপদ কর্মস্থল, কর্মীদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও ‘ফায়ার সেফটি’ বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিশ্চিতের লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়া জরুরী।’ নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ তাইয়েবুল ইসলাম বলেন, একজন নারী শ্রমিক যদি মানসিক শান্তিতে কাজ করতে পারেন এবং তাকে যদি ভাল পরিবেশ দিতে পারি, তবেই আমাদের শিল্পের উন্নতি হবে। আসলে বিষয়টি অনেক কঠিন। কারণ এর সঙ্গে নানা সামাজিক বিষয় জড়িত। এগুলোর সমাধান একটু কঠিন। সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে শ্রমিকদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে।’ মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন বলেন, ‘রানা প্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টসের ভয়াবহ দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, দেশে আইন ও নিয়ম থাকলেও মালিকরা মানেন না। আবার যে সব মালিকরা শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের বিচার হচ্ছে না। ফলে নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। শ্রমিকদের নিরাপত্তায় যারা কাজ করছেন তাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক নির্বিশেষে সকল শ্রমিককে শ্রম আইনের আওতায় আনা, ক্ষতিপূরণের জাতীয় মানদন্ড তৈরি করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ পুনর্বাসন নিশ্চিত করা, পেশাগত রোগে আক্রান্ত ও দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য প্রতিটি হাসপাতালে বিশেষ ইউনিট ও বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানান।
×