ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৬ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদন্ডের রায়ে ইসলামাবাদের উদ্বেগ ॥ ’৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অপব্যাখ্যা

আবারও নাক গলাল পাকিস্তান ॥ টানাপোড়েন

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

আবারও নাক গলাল পাকিস্তান ॥  টানাপোড়েন

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আবারও নাক গলিয়েছে পাকিস্তান। যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবু সালেহ মুহাম্মদ আবদুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয়জনের মৃত্যুদন্ডের রায়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটি। একই সঙ্গে ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অপব্যাখ্যা করেছে পাকিস্তান। এ নিয়ে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে অবস্থান করা পুরনো বন্ধুদের কিছুতেই ভুলতে পারছে না পাকিস্তান। বারবার পাকিস্তানকে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নাক গলাতে নিষেধ করলেও দেশটি তা শুনছে না। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ ফয়সাল জানিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবু সালেহ মুহম্মদ আজিজসহ ছয়জনের মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়ায় পাকিস্তান গভীর উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেছেন, আমরা আশা করব বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি মেনে চলবে। সেখানে তাদের ( যুদ্ধাপরাধীদের) বিচার থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন। শুক্রবার ওই ব্রিফিংয়ের তথ্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের ছয় যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। গত বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে একাত্তরে হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাবেক সাংসদ আবদুল আজিজসহ ছয়জনের মৃত্যুদ-ের রায় দেয়া হয়। এ রায়ের পরই পাকিস্তানের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অপব্যাখ্যাও অব্যাহত রেখেছে পাকিস্তান। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান শুরু থেকেই নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তারা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল আজিজসহ ছয়জনের মৃত্যুদ- রায়ের বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির লংঘন হয়েছে বলেও দাবি করে আসছে দেশটি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলারও অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। তবে ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি পাকিস্তানই মানেনি। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা হলেও তারা ফেরত নেয়নি। তারাই এ চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এছাড়া ১৯৭৪ সালের চুক্তিতে ১৯৫ পাকিস্তানী সেনা সদস্যের বিচারের কথা বলা হয়েছিল। পাকিস্তান সেসব সেনা সদস্যের বিচার কখনই করেনি। সেটা না করে আবারও ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অপব্যাখ্যা করছে পাকিস্তান। সূত্র জানায়, পাকিস্তানকে বারবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করলেও দেশটি সে কথা শুনছে না। বাংলাদেশের আহ্বানের প্রতি সাড়া না দিয়ে বারবার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলিয়ে আসছে পাকিস্তান। এর আগেও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে একাধিকবার নাক গলিয়েছে পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে দেশটির তৎকালীন ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশ। সে সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। এরপর জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ঘিরে দেশটি আবারও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিকবার সতর্ক করার পরেও পাকিস্তানের বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নাক গলানো নতুন কিছু নয়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তো বটেই; বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দেশটি নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। সে কারণেই যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েন চলে আসছে। এরই মধ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতি করে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে পাকিস্তান। চলতি মাসের শুরুতে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের ফেসবুক পেজে প্রচার করা একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার রফিউজ্জামান সিদ্দিকীকে তলব করে বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে বলা হয়। ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের ‘পাকিস্তান এ্যাফেয়ার্স’ নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়, যেখানে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান নন, জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। আর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমদ এ ব্যাপারে তখনকার মেজর জিয়াকে সমর্থন দেন।’ ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন তাদের ফেসবুক পেজে ওই ভিডিও শেয়ার করলে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর আসে। পরে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে পাকিস্তান হাইকমিশনের ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি সরিয়ে ফেলা হয়। তবে পাকিস্তানকে এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে বলা হলেও তারা সেটা না করে ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহসানকে পাল্টা তলব করে। এখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয়জনের মৃত্যুদন্ড রায়ের বিরুদ্ধে আবারও অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তান।
×