ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাওহিদা খানম তাসমিন

সিলেটের নারী প্রগতির পথিকৃৎ আনোয়ারা

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

সিলেটের নারী প্রগতির পথিকৃৎ আনোয়ারা

পঞ্চাশ দশকে সিলেট ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষেত্রভূমি। অনেক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে সিলেট অঞ্চল থেকে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এসব আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। হাতেগোনা কয়েকজন। নারীর মধ্যে আনোয়ারা বাসিত ছিলেন অন্যতম। পারিবারিক ঐতিহ্য আর রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য হয়েও আনোয়ারা বাসিত তৎকালীন পাকিস্তান আমলে অইয়ুবের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও গতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। আনোয়ারা বাসিত বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে আইয়ুবের স্বৈরশাসন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগ্রামে দীর্ঘ সময়ব্যাপী ছিলেন প্রথম সারির নেত্রী। এই নেত্রীর জন্ম ১৯৩৭ সালের ৭ মে ব্রিটিশ শাসিত অখ- ভারতের শিলচরে মুসলিম খান বংশীয় সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা মোহাম্মদ মোস্তফা খান ছিলেন একজন লেখক, লোককবি ও বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। মাতা সৈয়দা হাবিবুন্নেছা খাতুন সিলেটের গোপালগঞ্জ উপজেলার ঘোগারকুল গ্রামের সৈয়দ বংশীয়। বলতে গেল জন্মের পর থেকেই আনোয়ারা খাতুন প্রগতিশীল ও বিপ্লবী চেতনার স্পর্শ পান। মেয়ের শিক্ষা ও মানসিক বিকাশে পিতা মোহাম্মদ মোস্তফা খান ছিলেন কুসংস্কারমুক্ত। শিলচরের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাঠশালায় আনোয়ারা খাতুনের প্রথম হাতেখড়ি হয়। এরপর তার বয়স যখন দশ বছর, পিতার সিলেটের কালিঘাট চা বাগানে চাকরির সুবাদে সেখানে তার কিশোরী জীবন কাটে। সে সময়ে এতদাঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থা এতটা উন্নত ছিল না। বিশেষ করে নারী শিক্ষার হার ছিল অতি নগণ্য। অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া ছিল সামাজিক রীতি-নীতির আদর্শিক কাজ। তাই সমাজ ব্যবস্থার শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে মোস্তফা খান তার মেয়েকে ফেঞ্চুগঞ্জ কাশেম আলী হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে পড়ার সময় থেকে আনোয়ারা খাতুন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। কলেজে ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী এবং বিপ্লবী কর্মীদের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ ও পরামর্শে আনোয়ারা খাতুন সিলেট সরকারী মর্হিলা কলেজ থেকে রেড ক্রস নার্সিং স্কুলে ভর্তি হন। মানব কল্যাণের এক উৎকৃষ্ট মাধ্যম নার্সিং সেবা। যা ছিল তখনকার সময়ে বাম ধারার রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। পীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সারিয়ে তোলে প্রগতিশীল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করার এক অন্যতম মাধ্যম ছিল নার্সিং ক্ষেত্র। আনোয়ারা খাতুনও সে অনুযায়ী আত্মনিয়োগ করেন নার্সিং সেবায়। এ সময়ে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে তাকে। তার পরও তিনি পিছিয়ে থাকেননি, কৃতিত্বের সঙ্গে নার্সিং পাস করেন। শুধু তাই নয় তার মেধা মননশীলতা ও কর্তব্য নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে কর্তৃপক্ষ তাকে এ প্রতিষ্ঠানেই হেলথ ভিজিটর হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কল্যাণ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রেখে এ প্রতিষ্ঠানটির সুনাম অর্জনে সচেষ্ট হন। ১৯৯০ সালে ভারতের বাবরী মসজিদ ঘটনার প্রভাব সিলেটেও এসে পড়ে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হলে আম্বরখানা, লোহারপাড়া, ইলেকট্রিক সাপ্লাই সংলগ্ন এলাকা, চৌহাট্টা, সুবিদ বাজারসহ এতদাঞ্চলের কিশোর-তরুণদের একত্র করে আনোয়ারা বাসিত সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মোর্চা গঠন করতে সচেতনা সৃষ্টি করেন। আনোয়ারা খাতুন হাই স্কুলে পড়াকালীন রাজনীতি এবং সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। কিশোর বয়সেই তিনি বিপ্লবী নেত্রী হাজেরা খাতুন ও ষোড়শী চক্রবর্তীর সাহচর্যে আসেন। তাদের মাধ্যমেই তার বিপ্লবী চেতনার আত্মপ্রকাশ ঘটে। কিশোর বয়সেই তিনি অংশ নেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। শুধু তাই নয়, তিনি মাতৃভাষার দাবিতে সিলেটের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হলে তিনি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন। এ সময় আইয়ুব সামরিক শাসনে বাঁ নেতারা যখন আত্মগোপন করে জীবনকাটান তখন আনোয়ারা বাসিত তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তার বাসায় আত্মগোপন করেন কমরেড তারা মিয়া, পীর হাবিবুর রহমান, কমরেড প্রসূন কান্তি রায় (বরুণ রায়) ও আব্দুস সামাদ আজাদসহ আরও অনেক বড় বড় নেতৃবৃন্দ। আনোয়ারা বাসিত অত্যন্ত সাহসিকতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন তার কর্মস্থল সিলেট রেড ক্রস নার্সিং স্কুলে নজরদারি চালায়। তিনি কৌশলে অসুস্থতার অজুহাতে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। চাকরির বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি কাজ করেছেন আরও দুর্বার গতিতে। পরিবর্তন করেন কৌশল। কোন বাঁধাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ন্যায়ের পথে যেখানেই বাধা সেখানেই প্রতিবাদ সেখানেই লড়াই। ১৯৭০ এর অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী আনোয়ারা বাসিতের সময় দলবলে সকলেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। স্বদেশ ও সম্প্রীতির চেতনায় ছিলেন বিভাসিত। তারা ধৈর্য, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, নারীর মর্যাদা ও মানবতাবোধ সর্বোপরি মানবীয় মূল্যবোধ গঠনে বীরত্বের সঙ্গে পথ চলেছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় মহিলা পরিষদের সঙ্গে সিলেট মহিলা পরিষদ কার্যক্রমও অত্যন্ত জোরালোভাবে সক্রিয়। আনোয়ারা বাসিত দেশের ভেতর নিভৃতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সিলেট শহরে ও গ্রামের বাড়িতে থেকে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আনোয়ারা বাসিত ছিলেন অন্যতম নারী নেত্রী। স্বাধীনতার পর তিনি নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি পাড়া ও মহল্লাভিত্তিক গড়ে তোলেন সেলাই শিক্ষা কেন্দ্র ও কুটিরশিল্প, বয়স্ক শিক্ষা। এ ছাড়া তিনি মালনিছড়া ও লাক্কাতুরা চা বাগানে কর্মরত নারীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেন। সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গনেও ছিল তার নিরলস অংশগ্রহণ। তৎকালীন সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ছিলেন তখন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আমিনুর রশীদ চৌধুরীর উদ্যোগে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। দেশ প্রেমের চেতনায় তিনি ছিলেন আপোসহীন, সামাজিক দায়বদ্ধতায় তিনি ছিলেন কর্মময়ী। সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা আন্দোলন, সিলেট বিভাগ আন্দোলন এবং সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনেও আনোয়ারা বাসিত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় সিলেটে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। ১৯৯৮ সালে নিজ পরিবারের আর্থিক সহায়তায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আনোয়ারা বাসিত ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য দুস্থ, অসহায় ও দুর্যোগকবলিত মানুষকে সহায়তা, গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় সহায়তা করা, বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের স্বাবলম্বী করা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও গুণীজনদের সম্মাননা প্রদান ইতাদি। তা ছাড়া নি¤œবিত্ত, শ্রমজীবী ও শব্দকরদের মাঝে শীতবস্ত্র, শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ প্রদানে এ ফাউন্ডেশনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ২০০৯ সালে ঢাকায় সিলেট ‘রতœগর্ভা মা’ সম্মানে ভূষিত করা হয় এবং তাকে এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালে হাওড়পাড়ের ধামাইল কর্তৃক মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ ৮৬ বছর বয়সে আনোয়ারা বাসিত মারা যান। সিলেটের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তিনি তার কর্মে আজও দৃষ্টান্তরূপে বিরাজ করছেন। সিলেটবাসী মহান এই ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাব তার সৃষ্ট কর্মের মাঝে। তিনি অধিকার বঞ্চিত, শোষিত, নিষ্পেষিত নারীদের জাগরণে একজন অগ্রদূত হিসেবে সবার হৃদয়ে চিরদিন থাকবেন।
×