ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোমেনা আফরোজ

অনুগল্প ॥ ডোরবেল

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

অনুগল্প ॥ ডোরবেল

লিয়ানা বসে আছে অন্ধকারে। বারান্দায়। সেই অন্ধকার ভেদ করেও তার কান্না বোধগম্য হয়ে ওঠে। কান্নার নিজস্ব একটা ভাষা আছে। এই ভাষা কেবল অনুভূতিসম্পন্ন মানুষেরাই বোঝেন। আর যাদের কাছে এই ভাষা দুর্বোধ্য লিয়ানা তাদের ঘৃণা করে। তাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চায় না। -লিয়ানা, তুমি কি তোমার সিদ্ধান্তে অটল? - অতীতে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল সত্যি। সেই কারণে হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেও পারিনি। কিন্তু আজ আমি এ বিষয়ে সন্দেহমুক্ত। -তবে তুমি কাঁদছ কেন? একটু থেমে তিনি পুনরায় যোগ করেন। তোমার কান্নাই বলছে তুমি অটল এবং স্থির নও। -হয়তো তাই। কিন্তু তাতে আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে না। -তুমি আরেকবার ভেবে দেখতে পার। -এখানে ভাবার কিছু নেই প্রভু। আপনি তো সবই জানেন। এও জানেন, আমার কোন বসন্ত নেই। -সত্যিই কি বসন্ত নেই লিয়ানা? এই যে তুমি মনে-প্রাণে তোমার প্রভুকে স্মরণ করছো, তোমার অন্তরে উজ্জ্বল আলোর আভাস, একাকীত্বকে বশীভূত করে তোমার হৃদয়জুড়ে বিচরণ করছে ভেড়া পাল এগুলো কি বসন্তের ফুলগুলোর চেয়েও সুবাসিত নয়? -অবশ্যই সুবাসিত প্রভু। সে তো তোমারই করুণা। কিন্তু আমি আঠারো বছরকে ভুলতে পারার মতো শক্তিশালী নই। -এই ভুলতে না পারা তোমার ব্যর্থতা এবং দুর্বলতা। -মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার সন্তানদের ভ্রুণ হত্যা এবং মাতৃত্বহীনতা তারচেয়েও বড় ব্যর্থতা। আর এই চারদেয়াল, সংসার এগুলো তো দুর্বলতারই সাক্ষী। -একজন মা হিসেবে তোমার মধ্যকার অপার শক্তি এবং সম্ভাবনাকে তুমি জাগাতে পারোনি লিয়ানা। এর দায় কেবল তোমার। আমার নয়। কণ্ঠের দৃঢ়তা টের পেয়ে একটু ঘাবড়ে যায় লিয়ানা। বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস অবমুক্ত করে ভাবতে থাকে অতীতের ভুলগুলো। উর্বরতার দিনগুলোতে সে যদি আর একটু কৌশলী হতো তবে হয়তো আজ নীরবতার পরিবর্তে সন্তানদের কোলাহলে মুখরিত হতো চারদিক। তবে এটাও মিথ্যা নয়, স্বামীর মদের ভাগাড়ে ডুবে থাকায় যে অনিশ্চয়তাবোধ তৈরি হয়েছিল তাতে নতুন প্রাণের কথা ভাবতে পারেনি সে। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। যখন একটু একটু করে প্রভু পরম মমতায় দখল করে নিচ্ছিলেন তার আত্মা এবং শরীর তখন মাতৃত্ব ধারণের সুযোগ আর নেই। -লিয়ানা আরেকবার ভেবে বল, তুমি কি সত্যি তোমার স্বামীর মৃত্যু কামনা কর? তুমি চাইলে ক্ষমা করতে পার। -না। আমি তাকে ক্ষমা করতে পারি না। স্ত্রী হিসেবে ক্ষমা করতে পারলেও একজন মা হিসেবে আমি ক্ষমাহীন। বিয়ের পর থেকে দেখছি তিনি প্রতি সন্ধ্যায় পানশালায় গমন করেন। এই কাজে তিনি এতটা অভ্যস্ত যে মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার পথটাও ভুলে যান। আমাদের বিবাহবার্ষিকী, আত্মীয়স্বজনের বিয়ে কিংবা অন্য কোন অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম নিতান্ত একা। একাকীত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এখন নীরবতাই একমাত্র সঙ্গী। তার অস্তিত্ব, চলাফেরা, কথাবার্তা আমাকে রক্তাক্ত করে। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু যেন হাঁপিয়ে যায় লিয়ানা। তারপরেও বলতে থাকে, ইদানীং তিনি যখন মধ্যরাতে পানশালা থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেন তখন কলোনির কুকুরদের আর্তনাদধ্বনি আমাকে শুধু টুকরো টুকরো করে না, ভীতসন্ত্রস্তও করে। তারপর ডোরবেল... শব্দটি বলে মৃদু হেসে ওঠে লিয়ানা। নিজেকে উপহাসের এই ভঙ্গিটা তার নতুন নয়। যে ডোরবেলের জন্য এত বছর অপেক্ষা করেছি সেই শব্দে এখন বিভীষিকা জাগে। মনে হয় নীরবতার খুনী একজন পাপাত্মার প্রবেশ ঘটেছে গৃহে। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই আমার প্রিয় সঙ্গীর প্রস্থান ঘটে। আমি এই প্রস্থানকে কোনমতেই মেনে নিতে পারি না প্রভু। লিয়ানা কিছুক্ষণ নীরব থেকে পুনরায় নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে চলে, প্রভু আমার এই অশ্রুপাত তাকে হারানোর ভয়ে কিংবা অনুশোচনায় নয়। বরং আমি কষ্ট পাচ্ছি, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অনেকটা সময় অপচয় করে ফেলেছি ভেবে। এমন সময় লিয়ানা শুনতে পায়, মধ্যরাতের নীরবতাকে জখম করে অদূরে একদল কুকুর ডাকছে। সে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যেন বিড়ালের ভয়ে পলায়নরত ইঁদুর। বিশাল বারান্দায় ছুটতে থাকে উন্মাদের মতো। গ্রিলের ওপাশে তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু বাইরে অটুট অন্ধকার। কিছু দেখতে না পেয়ে ডাকে, প্রভু। আপনি কি আছেন? অপর প্রান্ত থেকে কোন উত্তর না পেয়ে লিয়ানা অস্থির হয়ে পড়ে। হতাশার স্বরে বলে, প্রভু আপনিও কি সবার মতো প্রিয় বছকে পরিত্যাগ করেছেন? ঐ যে কুকুরগুলো এগিয়ে আসছে। এখনি ডোরবেল বাজবে। প্রভু একজন মাতালের প্রলাপবাক্য থেকে আমাকে রক্ষা করুন। হঠাৎ কী কারণে যেন ঘুম ভেঙ্গে যায় লিয়ানার। প্রথমে ব্যর্থ হয় বুঝতে কোথায় আছে সে। কিছু সময় গত হলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে তার অবস্থান। প্রতিদিন অপেক্ষা করতে করতে সে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে সোফা ওপর। এমন আধোঘুমের পর খুব এলোমেলো লাগে তার। আবার দুঃস্বপ্নও দেখে মাঝে মাঝে। তখন সদর দরজার উপর প্রচণ্ড রাগ হয়। মনে হয় খণ্ড খণ্ড করে খুলে ফেলে দরজা। প্রতিদিনের এই দাসত্ব থেকে সে অব্যাহতি চায়। লিয়ানা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, রাত প্রায় দুটো। সে মাত্র আধঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছে। এতোক্ষণে মনে পড়ে একটু আগের স্বপ্নের কথা, যেখানে প্রভু তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেই স্বপ্নের রেশ এখনো মন জুড়ে বিস্তৃত। শরীরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। এমন সময় কুকুরের ডাকে ভেতরটা কেঁপে ওঠে লিয়ানার। সে জানে আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপর ডোরবেলের তীক্ষè ধ্বনি কেড়ে নেবে নীরবতার অস্তিত্ব। জ্বলে উঠবে বাতি। উফ! বাতিগুলোকে তার অসহ্য লাগে। আর গৃহে প্রবেশের পর তিনি সারাদিনের সব কথা উগড়ে দিতে চান। কিন্তু ঐ সব অপলাপের চেয়েও ঘুম প্রিয় লিয়ানার। অনেকক্ষণ শুনতে পাচ্ছে কুকুরের আর্তনাদ। কী এক অশুভ ইঙ্গিতে তারা যেন ছিঁড়ে ফেলছে রাত! সাধারণত ওরা এমন বিরামহীনভাবে ডাকে না। এদিকে দারোয়ানগুলোরও কোন খবর নেই যে থামাবে। মধ্যরাতের পর ওরাও ঘুমিয়ে পড়ে কোন কোনদিন। একমাত্র তাকে জেগে থাকতে হয়। সারা বছর। লিয়ানার মনে হলো, আজ যেন কুকুরগুলো উন্মাদের মতো আচরণ করছে। সেই কখন থেকে একটানা করুণ সুরে ডেকে ডেকে বিদ্ধ করছে তার কান এবং হৃদয়। থামার নাম পর্যন্ত নেই। এতক্ষণে ডোরবেলও বাজার কথা। প্রতি রাতে অদৃশ্য বুলেটের মতো যে ডোরবেলের শব্দ তাকে ক্ষতবিক্ষত করে সেই ডোরবেল আজ কেন বাজছে না? লিয়ানার কান উৎকীর্ণ হয়ে আছে। কিন্তু ডোরবেল নিশ্চুপ। শুধু দূর থেকে কিছু মুক্ত বাতাস এসে তার কানে কী যেন বলে যায় ফিস ফিস করে!
×