১৬থেকে ১৮ নবেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৭’ অনুষ্ঠিত হল। ১৬ নবেম্বর সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমিতে ‘দ্য সংস অব মিহায়ার অব দামাস্কাস’খ্যাত কবি এই আন্তর্জাতিক সাহিত্য আসরের উদ্বোধন করেন।
উৎসবে ২৪ দেশের দুই শতাধিক সাহিত্যিক অংশ নিয়েছিলেন। প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ সাহিত্য জার্নাল ‘গ্রান্টা’র মোড়ক উন্মোচন হয়েছে লিট ফেস্ট প্রাঙ্গণে। বিদেশী অতিথিদের মধ্যে এবার অংশ নিয়েছিলেন সিরিয়ার কবি আদোনিস, নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক বেন ওক্রি, অভিনেত্রী টিল্ডা সুইন্টন, মার্কিন সাহিত্যিক লিওনেল শ্রিভার, পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় কথাসাহিত্যিক নবনীতা দেব সেন, কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ড্যালরিম্পেল, লেখক এসথার ফ্রয়েড প্রমুখ। বাংলাদেশ থেকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মঈনুল আহসান সাবের, আলী যাকের, সেলিনা হোসেন, শামসুজ্জামান খান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আসাদ চৌধুরী, আনিসুল হক, সলিমুল্লাহ খান, কায়সার হক, খাদেমুল ইসলামসহ দেড় শতাধিক সাহিত্য ব্যক্তিত্ব।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও এসব দেশের বংশোদ্ভূত লেখকদের ইংরেজী ভাষায় লেখা বা অনুবাদ করা সাহিত্যের সম্মানজনক ডিএসসি পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে লিট ফেস্ট প্রাঙ্গণে। এ বছর ‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার’ লিট ফেস্টের প্রথম দিনে ঘোষণা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক এই ফেস্টের সব থেকে চমকপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি সেশন ছিল আদোনিসের কবিতা পাঠ। ফেস্টের দ্বিতীয় দিন দর্শকদের কবিতা শুনিয়েছেন সিরিয়ার কবি আদোনিস। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক সাদাফ সায। বলা চলে যে, আদোনিসই ছিলেন এই লিট ফেস্টের প্রধান ও মূল আকর্ষণ।
১৭ নবেম্বর শুক্রবার বিকালে বাংলা একাডেমির লনে আরবের আধুনিক কবি আদোনিসের কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়। নিজস্ব ভঙ্গিমায় এ সময় নিজের কবিতা পাঠ করেন তিনি।
এ আয়োজনের শুরুতেই সিরিয়ার এই কবি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করেন সাদাফ সায। এরপর জেরুজালেম নিয়ে লেখা বই ‘আল কুদস’ থেকে আরবি ভাষায় লেখা দুইটি কবিতা পাঠ করেন আদোনিস। এরপর আরও দুটি কবিতার ইংরেজী অনুবাদ পড়ে শোনান সাদাফ।
মধ্যপ্রাচ্যের এ আধুনিক কবিকে সাহিত্যরস পিপাসুদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেই। ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি সিরিয়ায় জন্ম নেয়া এ ক্ষণজন্মা কবি পরিণয়ের পরেই লেবাননে স্থানান্তর হয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। পুরাণে আদোনিস নামে এক কবি আছেন। সেই কবি এই লেবাননে বাস করতেন। তার প্রেম ও মৃত্যু ঘটেছিল লেবাননেই। মৃত্যু আর পুনরুত্থানের পৌরাণিক কবির নাম এ কারণেই একালের কবি আদোনিস, যার আসল নাম আলী আহমদ সাইয়ীদ- গ্রহণ করেছিলেন।
আরবি সাহিত্যের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রীধারী খ্যাতিমান আদোনিস তার ভাস্বর সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরস্কারের জন্য একাধিকবার মনোনীত হয়েছিলেন। আরব্য অনেক পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। বর্তমানে প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাসরত এই কবি ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি সচেতন ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য তিনি সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। তিনি তার কাব্যে নব্যরীতির প্রয়োগ করে সনাতনধর্মী কবিতা থেকে বেরিয়ে এসে এক নবকাঠামো দানে আরবি কাব্যজগতকে দিয়েছেন এক শ্লাঘা।
পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিও তার বিরূপতা সর্বজনবিদিত। তার এপিকতুল্য কবিতা ‘নিউইয়র্কের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’ শীর্ষক কবিতাটি পড়লেই তা বোঝা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের জীবনের অসঙ্গতি, যুদ্ধ, অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি। তিনি দেশপ্রেম, নৈতিকতা, মানবিকতা, প্রাকৃতিক নিমগ্নতা তার কাব্যে প্রতিথ করেছেন। প্রেম-ভালবাসা তার কবিতার এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আদোনিসের কবিতাগুলো পড়ে নিচের দুটি প্রেমমূলক কবিতার অনুবাদ করেছি। যেখানে ভাষার ব্যবহার, শব্দচয়ন ও কাব্যরীতির ব্যবহার অনন্য।
১.
তোমার মতো আমরা প্রত্যেকেই
একবার করে মরেছি,
গাছের পাতার প্রবাহের ভিতর দিয়ে গিয়েছি
দুমড়ে মুচড়ে গেছি
আর নিগৃহীত হয়েছি
শীতকালীন হীমবাহে ঋজু হয়েছি,
সোনালী কোণকে দগ্ধিত হয়েছি,
পুনঃপুনঃ দগ্ধিত হয়েছি
অম্বর কোঁকড়িয়েছে সোনালী পাতার খোলসে
সৌরতাপে সোনা ঝালাইকৃত হয়েছে;
তোমার মতো আমরা প্রত্যেকেই
একবার করে মরেছি,
আমরা প্রত্যেকেই একটি পুরনো কাষ্ঠপথ অতিক্রম করেছি
আর দেখেছি শীতের ঝরে পড়া পত্র
সৌর অনলে স্বর্ণ হয়েছে
তাই কাষ্ঠফুলের জীবনও আঁধার হয়েছে।
২.
মন্দিরের সামনের সোনার মতো নয়
যেখানে তুমি দাঁড়িয়েছ
এরকম সোনার মতো সোনা নয়,
সেই সোনার মতোও নয় যা তোমার চপ্পলকে গতিময় করে,
না তুমি স্বর্ণ লুটকারী
তোমার বাটালের গোড়ালীর মাধ্যমে,
গত বছরের পাতার মতই এই স্বর্ণ,
হাতুড়ি দ্বারা পেটানো সমস্ত সোনা নয়
আর তোমার প্রেমিকের মুখমণ্ডলের উপর
প্রহারিত।
ললাট ও উম্মুক্ত স্তন
এই সোনার মতই:
তোমার মতো আমরা প্রত্যেকেই
একবার করে মরেছি,
তোমার মতো আমরা প্রত্যেকেই
দূরে দাঁড়িয়েছি,
তোমার মতোই প্রার্থনার জন্য যোগ্য হয়েছি।
শীর্ষ সংবাদ: