ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঋতু ও প্রকৃতির কবি

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

ঋতু ও প্রকৃতির কবি

তিনি নানামুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার সমগ্র জীবনের আলোচনা এ ক্ষুদ্র প্রয়াসে ব্যপ্তি করণ প্রায় অসম্ভব। আমার এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় তার কাব্যজমিনে চাষকৃত উৎকর্ষের সেরা কাব্যমালার মধ্যে ঋতু ও প্রকৃতি। তার কবিতার বিষয় প্রেম, প্রকৃতি, ব্যক্তিগত অনুভূতি, বেদনাময় স্মৃতি, জাতীয় উৎসবাদী, স্বদেশানুরাগ, মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মানুভূতি। অন্তরঙ্গ আবেগের বিশিষ্ট পরিচর্যায় এবং ভাষাভঙ্গির সহজ আবেদনঘন স্পর্শে তাঁর কবিতা সুন্দর ও আকর্ষণীয়। তার কাব্য চেতনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্যান্থেয়িজম, শেলীর আকাশচারী কল্পনা, কীটসের সৌন্দর্যানুভূতি খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনানন্দের বিষাদময়তা ও প্রকৃতি নিষ্ঠতা কবিকে স্পর্শ করে। তার কবিতার প্রধান আকর্ষণ ছিল বিষয়, ছন্দ ও প্রকৃতিগত সারল্য। কবি হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা পেতে খুব দেরি হয়নি। এখানেই হচ্ছে সুফিয়া কামালের প্রধান সাফল্য। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য সেটি হচ্ছে তার প্রকৃতিপ্রেম ও ঋতুর উদ্বেল। যে কোন সৌন্দর্য, বিশেষ করে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষকে আনন্দ দান করে। আর একজন কবিকে উদ্বেলিত করে তটিনীর ঢেউ, সকালের স্বচ্ছ শিশির, দোয়েলের শীশ, শীতের মধ্যরাতের টুপটাপ হিম পতিতের শব্দ, কচিপাতা, পূর্ণিমার জোসনা ইত্যাদি। উপর্যুক্ত সবগুলোই তার কাব্যজমিনে হয়েছে বাঙময়। সুফিয়া কামালও ঋতু ও প্রকৃতিকে ধারণ করেছেন নিজ মননে। মনন থেকে কাব্যের ফুলঝুরি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পাঠককুলের মানসে। বাংলা সাহিত্যের মহিলা প্রতিনিধিত্বকারী কবি সুফিয়া কামালের কবি মনন ও মানষে বর্ষার আগমন ও স্তুতি এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। পোয়েট এ্যান্ড পেইন্টার খ্যাত ইংলিশ কবি উইলিয়াম ব্লেক যেমন ‘ল্যাম্ব’ ও ‘টাইগার’ দুটি কবিতা দিয়ে ¯্রষ্টার সৃষ্টির দুটি বিপরীত কিন্তু অনিবার্য মহিমা তুলে ধরেন সুফিয়া কামালও তাই। বৈশাখের তপ্ত খরতাপের পরে আসে বর্ষা। বর্ষার নতুন জল ধারায় প্রাণে জাগে স্পন্দন। সজীবতায় প্রাণ ফিরে পায় বিশ্ব-ব্রহ্মা। ঝড়ের রুদ্রমূর্তির পরে সরস বর্ষার যে রূপের সন্ধান মেলে, তা কবির ‘ঝড়ের শেষে’ কবিতায় উঠে এসেছে- ‘মধুর মমতা ধারা বিথারিয়া আর্দ্র সমীরণে ভুলিয়া বেদনা জ্বালা শুচিস্মিতা প্রশান্ত আননে চাহিয়াছে ঊর্ধ্বমুখী সুকল্যাণী ঝঞ্ঝা বিশেষে যত ক্ষতি যত ব্যথা ভুলাইয়া ভুলিয়া নিঃশেষে।’ কবি সুফিয়া কামাল গবেষক ইয়াসমিন সুলতানা ‘বর্ষার প্রতীক্ষা’ কবিতার ব্যাপারে বলেন, ‘কবি এই কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। বর্ষার জলধারাকে কবি প্রিয়ার অভিমানিত অশ্রুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রিয়া এলায়িত ঘনকেশে দিগন্তের দিকে চেয়ে চেয়ে প্রিয়ের জন্য অপেক্ষা ও অশ্রু বিসর্জন করে। গ্রীষ্মের তপ্তরোদে বর্ষা তার ঘন মেঘ নিয়ে বর্ষণের জন্য অপেক্ষা করে। তারপর এক সময় তা ধরণীর বুকে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে।’ বাংলা মায়ের ছয় ঋতুর পালাবদল মহিলা প্রধান কবি সুফিয়া কামালের কাব্য মানসকে উদ্বেলিত করেছে বারংবার। এক ঋতু চলে গেলে অন্য ঋতুর আগমন ঘটে। তবে শরতের বিদায় সুফিয়া কামালের কাব্য মানসপাটে এক বেদনাবিধুর আবহ তৈরি করে। শরতের বিদায়ের সঙ্গে তার আয়োজনকে কবি স্মরণ করেছেন। যৌবনে মানুষ যেমন প্রাণচাঞ্চল্যে কর্ম-কোলাহলে মুখরিত থাকে; শরতকালে প্রকৃতিও সেই রূপ লাভ করে। প্রিয়া বিচ্ছেদে যেমন মানুষ কাতর হয় শরত চলে গেলে প্রকৃতিও তেমনি হয় এটি কবি ‘শরত আবার যেদিন আসিবে’ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। শরত বিদায় আর প্রিয়ের নিকট থেকে বহুদূরে চলে যাওয়ার স্মৃতিকে কবি এভাবে তুলে ধরেছেন- ‘সেই সুন্দর শরত আবার যেদিন আসিবে ফিরে, মনে করো সখি! মিলন নিশীথে এই তব সাথীটিরে।’ কবিতাজননী কবি সুফিয়া কামাল তিনি লিখেছেন ‘হেমন্ত’ বি সুফিয়া কামালের এই কবিতা ডানা মেলেছে ঠিক এভাবে, যেভাবে বাংলাদেশে হলুদ ফুলে সেজে হেমন্ত আসে। তিনি লিখেছেন, ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে কোন্ পাথারের ওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে? আনল ডেকে মটরশুঁটি, খেসারি আর কলাই ফুলে আনল ডেকে কুয়াশাকে সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।’ বসন্তের আগমনে গাছে গাছে ফুল ফোটে; মানবমনে শিহরণ জাগে, প্রকৃতি বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয়ে ফুল ও তার সৌরভ উপহার দিয়ে বসন্তকে বরণ করে। বসন্তের আগমনে প্রকৃতি ও মানব মনে এক মহোৎসব বিরাজ করে। এর প্রভাবে সবাই প্রভাবিত। কবি ও এর ব্যতিক্রম নন। তবে কেন আজ এই উদাসীনতা তাঁর? ঋতুরাজ বসন্ত তার রূপ নিয়ে ধরা দেয় প্রকৃতিতে। ফুল ফোটে, পলাশ রাঙায় মধুর রং, পাখি গান গায়, বাঁশি বাজে আনন্দে উদ্বেলিত হয় মানব মন। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি ও তাঁর ভক্তদের সংলাপে এমন কথা- বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমার মুকুল? দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?’ বসন্তের এতসব আয়োজন সত্ত্বেও কবি আজ বসন্তকে বরণ ও তাঁর জন্য অর্ঘ্য রচনা করতে পারছেন না।- ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি রভে নি কি ঋতুর রাজন? মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করেনি সে অর্ঘ্য বিরচন?’ কেননা, তাঁর সাহিত্য প্রেরণার প্রিয় ব্যক্তির বিয়োগ ব্যথার কথা কোনভাবেই ভুলতে পারছেন না। বসন্তের পরিবর্তে তিনি আজ শীত ঋতুকেই তাঁর ব্যথার সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। গ্রীষ্ম বা নববর্ষের বরণ কবিকে নাড়া দিয়েছিল। শীতের কোমলতাও কবি এঁকেছেন তার কাব্য পঙক্তিতে। প্রকৃতি অর্থই তো সৃষ্টিকর্তার মহান কারুকার্য। আর সেই মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে প্রকৃতিপ্রেমী কবি সুফিয়া কামাল নিপুণ হাতে কাব্যজমিনে প্রথিত করে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বারংবার। আল্লাহকে তাঁর নিখুঁত সৃষ্টি আমাদের সবার জন্য উপভোগ করতে দেয়ার জন্য তিনি তার ‘প্রার্থনা’ কবিতায় আল্লাহকে বলছেন, ‘তুলি দুই হাত করি মোনাজাত হে রহিম রহমান কত সুন্দর করিয়া ধরণী মোদের করেছ দান, গাছে ফুল ফল নদী ভরা জল পাখির কণ্ঠে গান সকলি তোমার দান।’ ‘ইতল বিতল’ কবিতায় কবি একটি বর্ষণমুখর সময়ের গ্রাম্য পরিত্যক্ত স্থানে গাছের নিচে পানি জমে আছে, পানিতে ব্যাঙের দুচোখ প্রকাশমান মাথা, পাশেই ছত্রাকে জন্মনেয়া ব্যাঙের ছাতাতে মেঘথেকে ঝরেপড়া বৃষ্টির ফোঁটার আঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে যাওয়ার চিত্রকল্প করেছেন এই মহিলা প্রতিনিধিত্বকারী কবি। যেমন, ‘ইতল বিতল গাছের পাতা গাছের তলায় ব্যাঙের মাথা। বৃষ্টি পড়ে ভাঙ্গে ছাতা ডোবায় ডুবে ব্যাঙের মাথা।’ প্রকৃতি নিমগ্নতাই মুখ্য ছিল এ জনপ্রিয় মহিলা কবির। তিনি প্রকৃতিকে ভালবেসে প্রাণে প্রাণে বেঁধেছিলেন ডোর। মানুষের নানা চাপের কারণে প্রকৃতি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রকৃতিকে নানা জটিলতা ও ক্ষতিগ্রস্ততার হাতথেকে রক্ষা করার জন্য যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে কবি আগামী দিনের ভবিতব্য কর্ণধার শিশুদেরকে এগিয়ে আসতে বলেছেন। দায়িত্ব নিয়ে প্রকৃতিকে উছ্ছলা যৌবনা নদীর মতোই বহমান করার আহ্বান জানাচ্ছেন ‘আজিকার শিশু’ কবিতায় এভাবে, ‘তোমাদের গানে, কল-কলতানে উছসি উঠিবে নদী- সরস করিয়া তৃণ ও তরুরে বহিবে সে নিরবধি তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর।’ প্রকৃতির নিরন্তর বহমানতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ও সেগুলোর মাঝে নিজ কবিমনের বিরাজ করে কাব্যে স্তুতি করা এ ব্যাপারে সুফিয়া কামাল কবি রবীন্দ্র্রনাথ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। সুফিয়া কামালের কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনায় যে শব্দগুচ্ছসমূহ এঁকেছেন সেগুলো হচ্ছে, শোণিতাক্ত দীপ্ত দ্বিপ্রহর, শোকাচ্ছন্ন অপরাহ্ন, সুপ্রসন্ন কিরণ, শ্বেত-শ্যাম অর্ধচন্দ্র-পূর্ণতারা আঁকা, প্রসন্ন প্রভাতে, আলোকদীপ্ত বেলা, দীপ্ত রাঙ্গা উদয়ের বেলা, পাখি-ডাকা রাঙা ভোর প্রভৃতি। বর্ণচোরা সনেটর
×