ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

অনলাইন ব্যবসা সর্বগ্রাসী হতে চলেছে!

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

অনলাইন ব্যবসা সর্বগ্রাসী হতে চলেছে!

আগামী বেশ কিছু দিন খদ্দেররা অনলাইনে কেনাকাটার পেছনে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে। বিশেষ করে ১১ নবেম্বর চীনে সিঙ্গলস ডে’তে এবং আমেরিকার ব্ল্যাক ফ্রাইডে’তে অর্থাৎ থাঙ্কস গিভিংসের পরের দিন খদ্দেরদের ভিড় উপচে পড়েছে দোকানগুলোতে। আর সারা বিশ্বে বড় দিনের আগে জোর কেনাকাটার ব্যাপার তো আছেই। এসব কেনাকাটার এক বড় অংশ হবে অনলাইনে। বস্তুতপক্ষে ই-কমার্সের এখন ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। গত এক দশক ধরে ই-কমার্স বছরে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এতে করে লজিস্টিক্স থেকে ভোগ্যপণ্য পর্যন্ত শিল্পগুলো দারুণভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। ই-কমার্স শেষ পর্যন্ত কি পরিণাম ডেকে আনবে ব্যবসায়ে তা নিয়ে আমেরিকায় বিতর্কটা যত তীব্রভাবে হচ্ছে অন্য কোথাও সেভাবে হচ্ছে কিনা সন্দেহ। কারণ আমেরিকায় এ বছর ই-কমার্সের জন্য হাজার হাজার দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে প্রতি ৯টি পেশার মধ্যে একটি হচ্ছে খুচরা ব্যবসা। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো অনলাইন শপিং সবেমাত্র শুরু হয়েছে। গত বছর অনলাইনে কেনাকাটার পরিমাণ ছিল বিশ্বের খুচরা কেনাকাটার মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ। আর আমেরিকায় এই হারটা ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। ব্যবসা ও সমাজের ওপর এর প্রভাব হবে বিশাল। সেটা শুধু এই কারণে নয় যে খুচরা ব্যবসায়ে বিপুল সংখ্যক লোক নিয়োজিত এবং এই ব্যবসা বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত, উপরন্তু এর আরও একটি কারণ হলো অনলাইন শপিংয়ের সবচেয়ে বড় দুই দিকপাল আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা এবং এ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস অনলাইন শপিংকে কাজে লাগিয়ে নতুন ধরনের পুঞ্জীভূত ও সমন্বিত ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। এগুলো গড়ে ওঠার ফলে ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতা বাড়বে না চাহিদায় টান ধরবে সেটাই প্রশ্ন। গত দুই দশকে আলিবাবা ও এ্যামাজন ক্লাউড কম্পিউটিং থেকে ভিডিও পর্যন্ত আরও অনেক সার্ভিস যোগ করেছে। ভোক্তারাও এসব কোম্পানির প্লাটফর্ম ব্যবহার করার সম্ভাবনা বেশি হয়ে ওঠায় এদের ব্যবসায় পরস্পরের শক্তি বৃদ্ধি করবে এবং আয়ের উৎসগুলোও বিভিন্নমুখী হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে তা হতেও শুরু করে দিয়েছে। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে দুই মহাপরাক্রান্ত অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব ধরনের ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রে বসে আছে। আমেরিকায় এ্যামাজন সপ্তাহের পর সপ্তাহ দেখিয়ে দিচ্ছে যে একটা উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন ই-কমার্স ফার্ম পরিণত বাজারের কি বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে পারে। চীনে আলিবাবা দেখিয়ে দিচ্ছে যে দ্রুত বর্ধিষ্ণু একটি অর্থনীতিতে একটা কোম্পানি কত নাটকীয়ভাবে ব্যবসার চেহারা পাল্টে দিতে পারে। ওরা যে শিল্পকে স্পর্শ করে সেই শিল্পই যে জয় লাভ করে তা নয়। তবে তা সুবিশাল প্রভাব রাখে। একদিক থেকে দেখলে এতে করে প্রতিযোগিতা জোরদার হচ্ছে। এ্যামাজন ও আলিবাবার ই-কমার্স সাইটগুলো ক্ষুদে উৎপাদকদের পণ্য বিতরণ ও সম্ভাবনাময় ক্রেতা খুঁজে বের করার সহজ ও সস্তা উপায় যুগিয়ে বাজারে প্রবেশের পথে অন্তরায়গুলো কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় প্রস্তুতকারকরা বহুজাতিক বৃহৎ কোম্পানিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে। এতে ভোক্তারা লাভবান হচ্ছে। কেননা তারা আগের চেয়ে আরও বেশি পরিমাণে ও ভাল মানের পণ্য বেছে নিতে পারছে। কিন্তু বৃহৎ ই-কমার্স ফার্মগুলোর প্লাটফর্ম প্রসারিত হওয়ায় তাদের শক্তিমত্তা নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে। সস্তায় মূলধন বা পুঁজি লাভের সুযোগ থাকায় এ্যামাজন এখন পণ্যাগার, কৃত্রিম বুদ্ধি ও অন্যান্য ক্ষেত্রসহ বড় ধরনের বিনিয়োগে যেতে পারছে। যেমন গত বছর এ্যামাজন হোল ফুডস নামে একটি মুদি প্রতিষ্ঠান ১৩৭০ কোটি ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছে। এতে অন্য প্রতিযোগীদের পাল্লা দিয়ে চলার জন্য বেগ পেতে হচ্ছে। এমনটি মনে করার সার্বিক কারণ আছে যে ই-কমার্স আরও বিশাল আকার ধারণ করবে। ধনী দেশগুলোতে ইতোমধ্যে তা ব্যাপক রূপ নিয়েছে। আর গরিব দেশগুলোতে আয় বৃদ্ধি ও মোবাইল ফোনের বিস্তারের ফলে আরও বেশি সংখ্যক খদ্দের অনলাইনে চলে আসছে। চীনে অনলাইনে ব্যয় ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি হবে এবং মোট খুচরা বিক্রির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হবে অনলাইনে। আমেরিকায় অনলাইনে কেনাকাটার ভাগ গত বছরের প্রায় এক দশমাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে এক-ষষ্ঠাংশে দাঁড়াবে। ব্রিটেনে এই ভাগটা বেড়ে এক-পঞ্চমাংশ হতে পারে। ই-কমার্সের বিরামহীন প্রসার একটা পর্যায়ে হয়ত তার স্বাভাবিক সীমানা ছাড়িয়ে যাবে। তখন হয়ত এটা আর অতটা আকর্ষণীয় হবে না। তবে সন্দেহ নেই এখনও ই-কমার্স বহুদূর যেতে পারে। তথাপি কতদূর যাবে, কত দ্রুত উপরে উঠবে, কোথায় সবচেয়ে ভাল করবে, এর প্রভাব কত বিশাল হবে এখনও তা পরিষ্কার নয়। এ্যামাজনের যাত্রা শুরু হয়েছিল বই বিক্রি দিয়ে। ১৯৯৯ সালে এক ব্যবসায় সাময়িকীতে প্রচ্ছদ কাহিনী বেরিয়েছিল ‘এ্যামাজন বোম্ব’ শিরোনামে। তখন বলা হয়েছিল এ্যামাজনের যতই প্রসার ঘটুক না কেন এই কোম্পানিকে ‘ওয়ালমার্ট’ এবং ‘বার্নস এ্যান্ড নোবল’-এর মতো মহাপরাক্রান্ত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। কিন্তু এ্যামাজনের ক্রমপ্রসারের পরিধি যে কতদূর ব্যাপ্ত হবে তা কেউ তখন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি। আজ এ্যামাজন এক বিশাল কনগ্লোমারেট। এই কনগ্লোমারেটের সবচেয়ে লাভজনক শাখা হলো ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবসা। গত বছর এ্যামাজনের অপারেটিং আয়ের ৭৪ শতাংশ এখান থেকেই এসেছিল। এর প্রথম হেডকোয়ার্টার নিউইয়র্কে। দ্বিতীয় হেডকোয়ার্টার সিউলে। সেখানে এটি ৪০ হাজারেরও বেশি কর্মীর কর্মসংস্থান করেছে। বিশ্বব্যাপী এ্যামাজনের শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা আরও ৩ লাখ ৪০ হাজার। গত ৩০ জুন পর্যন্ত এক অর্থবছরে এ্যামাজন নতুন প্রযুক্তির পণ্যের ক্লাউড ও ই-কমার্স ব্যবসার পেছনে প্রায় ১৩০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে যা গুগলের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি এবং ফেসবুকের তিনগুণেরও বেশি। তবে এ্যামাজনের সবচেয়ে বড় প্রভাবের ক্ষেত্র এখনও ই-কমার্স। গত বছর আমেরিকায় অনলাইনে কেনাকাটার পেছনে ব্যয় যত বেড়েছে তার অর্ধৈকেরও বেশি বেড়েছে এ্যামাজনের জন্য। পণ্যের খোঁজখবর গুগলে যত করা হয় তার চেয়ে বেশি করা হয় এ্যামাজনে। ওদিকে চীনেও ই-কমার্সের রমরমা অবস্থা চলছে। গত বছর চীনে অনলাইনে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৬শ’ কোটি ডলার, তা আমেরিকা ও ব্রিটেনের অনলাইনে বিক্রি এক করলে যা দাঁড়ায় তার কাছাকাছি। ধারণা করা হচ্ছে যে ২০২০ সাল নাগাদ সে দেশে মোট খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে অনলাইনে বিক্রির ভাগ বেড়ে ২৪ শতাংশে দাঁড়াবে। চীনের সবচেয়ে বড় নগরীগুলোর প্রায় ৮০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা অনলাইনে কেনাকাটা করছে। অনলাইনে উত্তরণের কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে আলিবাবা। কোম্পানির আয়ের বেশিরভাগ আসে বিজ্ঞাপন থেকে। এখন এটি ভোক্তাদের জীবনে এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যা এখনও আমেরিকা ও ইউরোপে দেখা যায়নি। কোম্পানিটি তার অনলাইন ব্যবসাকে বহুমুখী করতে প্রতিষ্ঠা করে সহযোগী প্রতিষ্ঠান তাও বাও, টি-মল, আলীপে, এন্ট ফিন্যান্সিয়াল ইত্যাদি। আলীপে কেনাকাটা, বিল পরিশোধ ও টাকা প্রেরণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রায় ৫২ কোটি চীনা এটা ব্যবহার করছে। এ্যামাজনের এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই। ইউরোপীয়রা এখনও ক্রেডিট কার্ডই আঁকড়ে ধরে আছে। গত বছর আলীপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা পেপালের চেয়ে আড়াইগুণ এবং এ্যাপলপের চাইতে ১১ গুণ বেশি ছিল। আলিবাবার অনলাইন বাজার ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। এতে নতুন নতুন সার্ভিসও যুক্ত হচ্ছে। এটা যে সব ধরনের পণ্যই শুধু বিক্রি করছে তা নয়। এটি স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও সার্ভিসেও ঢুকে পড়েছে। আলী হেলথ নামে এরই আরেক অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসা করছে। বিশ্বের বৃহত্তম হোটেল চেইন ম্যারিয়েটের সঙ্গেও যৌথ অংশীদারিত্বে যুক্ত হয়েছে আলিবাবা, এটি ইউকু নামে একটি ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটেরও মালিক। আলিবাবা ওয়েইনু নামে টুইটারের মতো সামাজিক মিডিয়া কোম্পানিতেও বিনিয়োগ করেছে যার গ্রাহকসংখ্যা ৩৬ কোটিরও বেশি। ডিডি নামে একটি রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও আছে আলিবাবার। এভাবে আলিবাবার সাম্রাজ্য সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করছে। আলিবাবার প্রতিদ্বন্দ্বী যে নেই তা নয়। এ মুহূর্তে প্রধান দুই প্রতিযোগী জেডি ও টেনসেন্ট। আলিবাবা বাইরেও তার কার্যক্রম ছড়িয়ে দিচ্ছে। ২০১৪ সালে এ্যামাজন বৈশ্বিক পরিসরে বাজার বিস্তারের এমন পদক্ষেপে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে ৫শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে। দেখাদেখি দু’মাস পরে আলিবাবা দিল্লীতে গিয়ে হাজির হয় এবং ভারতীয় ডিজিটাল পেমেন্ট কোম্পানি পেটিএমএ ৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করে। অনলাইন ব্যবসার এই দুই অধীশ্বর ভারতে বাজার দখল নিয়ে রীতিমতো তুমুল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এভাবে বিশ্বের দেশে দেশে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের অনলাইন ব্যবসা। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×