ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুগাবের পতন

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

মুগাবের পতন

বিস্তর জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পদত্যাগের মাধ্যমে জিম্বাবুইয়েতে অবসান ঘটল মুগাবে যুগের। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট পদ আঁকড়ে ছিলেন। বয়স ৯৩ বছর হলেও ছাড়তে চানটি ক্ষমতা। ক্ষমতার মোহ এমনই অমোঘ ও দুর্নিবার যে, শেষাবধি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন ৪০ বছরের ছোট দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে ক্ষমতার উত্তরসূরি হিসেবে রেখে যেতে। ভেবেছিলেন এতে অন্তত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা যাবে। এর জন্য পথ পরিষ্কার করতে ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়াকে বহিষ্কার ও ক্ষমতাচ্যুত পর্যন্ত করেছিলেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। দেশের সেনাবাহিনী মুগাবের এই অনৈতিক ও অসাংবিধানিক পদক্ষেপ সমর্থন করেনি। অতঃপর প্রধান সেনাপতির নেতৃত্বে মুগাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তারা। রাস্তায় নেমে আসে সাঁজোয়া যানও। মুগাবের অপশাসন ও দুঃশাসনে অতিষ্ঠ এবং অত্যাচারিত সাধারণ মানুষও নেমে আসে রাস্তায়, স্বাগত জানায় সেনাবাহিনীকে। ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন চলে যান আত্মগোপনে। সেখান থেকেই নাড়তে থাকেন কলকাঠি। ইতোমধ্যে নিজ দল জানু-পিএফ থেকে বহিষ্কার করা হয় মুগাবেকে। পার্লামেন্ট থেকে শুরু হয় মুগাবের ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম-অপশাসনের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া। এ অবস্থায় পদত্যাগে বাধ্য হন এককালীন ক্ষমতাশালী একনায়ক রবার্ট মুগাবে। পদত্যাগপত্রে যদিও তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগের কথা উল্লেখ করেছেন, বাস্তবে তাকে দেশ ত্যাগের শর্তে ক্ষমতা ছাড়তে বলা হয়েছে। তবে তার স্ত্রী গ্রেসকে দেশত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়নি। অতঃপর আশা করা যায় সেনাবাহিনীর সম্মতিতে আপাতত সে দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন বহিষ্কৃত ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়া। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে তাকেই জানু-পিএফ দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হতে পারে। মূলত এটি ছিল একটি অদৃশ্য অভ্যুত্থান। সেনাবাহিনী কোন রক্তপাত ঘটায়নি, সংবিধানও স্থগিত করেনি। বাস্তবে কিন্তু রবার্ট মুগাবে এরকম ছিলেন না। মূলত তিনি তৎকালীন রোডেশিয়া, বর্তমানে জিম্বাবুইয়ের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নায়ক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জানু দলের পক্ষে মুগাবে এবং জাপু দলের পক্ষে জশুয়া এনকোমো সশস্ত্র বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৮০ সালে মুক্ত হয় রোডেশিয়া। আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন জিম্বাবুইয়ে নামে। ১৯৮২ সালে এনকোমোকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার ও ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে শুরু হয় ক্ষমতা সংহতকরণের প্রক্রিয়া। ১৯৮৭ সালে জানু ও জাপুকে একীভূত করে জানু-পিএফ দল গঠিত হয়। একই সঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, দল এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে সর্বময় ক্ষমতা সংহত করার মাধ্যমে আবির্র্ভূত হন একনায়ক তথা লৌহমানব হিসেবে মুগাবে। হাজার হাজার লোককে হত্যা ও নির্বাসনে পাঠানো হয়। ঔপনিবেশিক পরবর্তী সময়ে জিম্বাবুইয়ের ‘জাতির পিতা’ একটানা ৩৭ বছর ক্ষমতায় থেকে পরিণত হন খলনায়কে। কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা মুগাবেকে পশ্চিমা দেশগুলোতেও অভিহিত করা হতো ‘থিংকিং-ম্যানস গেরিলা’ অভিধায়। প্রতিবেশী দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৪ সালে জাতিগত বিদ্বেষ অবসানের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থানরত নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তবে প্রধানত জমি জাতীয়করণসহ ব্যাপক স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ১৯৯০ সালের পর থেকে জিম্বাবুইয়ের অর্থনীতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। মূল্যস্ফীতি সকল সীমা অতিক্রম করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাপক দমন-পীড়ন। প্রকারান্তরে যা দেশটির জন্য সৃষ্টি করে মহাবিপর্যয়। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসকের অনিবার্য পতন। অথচ জিম্বাইবুয়ে বৃহদায়তন, খনিজ ও বনজসম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী একটি দেশ, যেটি অমিত সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। অবশ্য ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসনের বিরুদ্ধেও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। সে অবস্থায় আগামীতে দেশটি কোন্ পথে অগ্রসর হয় সেটিই এখন দেখার বিষয়।
×