ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

তির্যকের নাট্যমেলায়

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

তির্যকের নাট্যমেলায়

আলী যাকেরের বক্তব্য হৃদয়স্পর্শী, চলচ্চিত্র না, টেলিভিশন না, আমার স্থান মঞ্চে কিন্তু অসুস্থতায় আসতে পারছিলাম না। এটা বেদনার কিন্তু আজ এলাম এটা আনন্দের। আশা, গ্যালিলিও নিয়ে ফিরব। অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘আসাদুজ্জামান নূরের মতো ব্যক্তি মঞ্চে আছেন জানলে আমার আসতে ভাল লাগে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা এবং রুচি তার মধ্যে অনন্য। ভাল লাগে হলভর্তি দর্শকদের উপস্থিতি, কেননা সেখান থেকে টের পাওয়া যায় দর্শকদের ভালবাসা।’ নাট্যাঙ্গনে নাটকের মানুষ যে সদাই ব্যস্ত সেটি একমাত্র কাজের অফার নিয়ে গেলেই বোঝা যায়। কি কাজ, কখন কাজ, কোথায় কাজ সেসব না শুনেই তিনি কত ব্যস্ত, কি ব্যাপক চাহিদায় তিনি উদভ্রান্ত এবং খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ডাকেও সাড়া দিতে না পেরে তিনি কতটা লজ্জিত এই বিষয়ে তার কথা বলার অবসরের শেষ নেই। তবু সত্যিকার কাজের মানুষের তো ব্যস্ততা বোঝাবার মতো অবসর নেই। তারই প্রমাণ গত ১৭ নবেম্বরের সন্ধ্যা। যত দেশে গেছেন তত দেশ থেকেই পছন্দের হাত ঘড়িটা কিনে হাতে পড়ে সময় ধরে কাজ করার মানুষ রামেন্দু মজুমদার, ঠিকই এক্সপেরিমেন্টাল হলে মায়া নদী নাটক মঞ্চায়নের পূর্বে জাতীয় নাট্যশালার লবিতে দাঁড়িয়ে ওই ডান হাত দিয়েই সিগনেচার করে উদ্বোধন করলেন ‘তির্যক নাট্যমেলা ২০১৭’। চোয়াল্লিশ বছর কোন রকম বিরতি ছাড়াই চোয়াল্লিশটি নাটক প্রযোজনা এবং ২৬১৯টি মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টিকারী নাট্যদল, চট্টগ্রামসহ সারাদেশেই দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নাটকে নিবেদিত নাট্যদল তির্যক তাদের চলমান ৪৪ বছরের চলমান পথ পরিক্রমাকে সামনে রেখে ১৭ থেকে ১৯ নবেম্বর পর্যন্ত মোট তিন দিনব্যাপী, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আয়োজন করে তির্যক নাট্যমেলা ২০১৭। ১৯৭৪ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে প্রযোজিত ৪৪টি নাটকের মধ্যে থেকে আঞ্চলিকতা-জাতীয়তা এবং আন্তর্জাতিকতা বিষয় আশ্রিত তিনটি নাটকের মঞ্চায়ন, নৃত্য-গীত-আবৃত্তি-মুকাভিনয় প্রভৃতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানর মুক্তমঞ্চে উপস্থাপন, থিয়েটার বিষয়ক ভাবনার আদান প্রদান রুপী সেমিনার আয়োজন, ৪৪ বছরের স্মৃতি বিস্মৃতির নাট্য স্মারক প্রদর্শন এবং তির্যক সম্মাননা জ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হলো নাট্যানুরাগীদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চায়িনী নাট্যমেলা তির্যক নাট্যমেলা ২০১৭। তির্যক নাট্যদলের প্রাণ পুরুষ, অভিনেতা-নির্দেশক-দলপ্রধান আহমেদ ইকবাল হায়দার যতটা ন¤্র অন্তরঙ্গে ততটাই শক্ত। ফলে দক্ষ মালির মতোই তার নাট্যনির্মাণ নিয়ন্ত্রণের কারণে জঙ্গল না হয়ে পুষ্পফলে শোভিত সাজানো বাগান। বিসর্জন, ইডিপাস এবং তরঙ্গভঙ্গ নাটক তিনটি মঞ্চায়ন দেখে দর্শকদের অনুভূতি যে রকম, ১. অদৃশ্যমান খর¯্রােত রূপী পা-ুলিপির দৃশ্যমান গর্জনের উপস্থাপন। ২. শক্তিশালী ক্ষিপ্র অভিনয় এবং সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এক সুতায় সমন্ধয়। ৩. সেট-লাইট- প্রপস-অভিনয় মিলে মিশে যেন মঞ্চনাটকের পেইন্টিং। ঢাকার দর্শক বুঝে গেল, করণীয় কাজটা ঠিকমত হলে নাটক শেষে দলপ্রধান বা সংগঠককে এসে মায়াকান্না করে বলতে হয় না, দর্শক আপনারা আছেন বলেই আমরা আছি। যেমন বলা লাগল না দলপ্রধান আহমেদ ইকবাল হায়দারকে। কে কত বেশি শেক্সপিয়ার-ব্রেশট আর আর্নেস্ট হেমিং ওয়েকে বোঝে সেটা বোঝাবার ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ে, নাসির উদ্দীন ইউসুফের আলোকপাত করা দৃষ্টি ভঙ্গি কিছুটা চাপা পড়লেও সেমিনার আর আড্ডার মাঝামাঝি নাট্যভাবনা ছিল নাট্যমেলার অন্যতম আকর্ষণ। হোমওয়ার্ক না করে কথা বলার কারণে মামুনুর রশীদের উপস্থাপনা ছিল ক্লান্তিকর কিন্তু প্রতি আক্রমণ ঠেকাতে যেয়ে উপস্থাপিত যুক্তিগুলো ছিল নান্দনিকভাবে তির্যক। ভাবনার আদান-প্রদানে একটা বিষয় পরিষ্কার, অহেতুক কথা বলে, আত্মকথা বাধ্যতামূলক শুনিয়ে, শব্দদূষণের মাত্রা বাড়ানোর দিন শেষ। বিষয়ে নিমঘœ হয়ে তাড়িত ও জাড়িত হয়ে নতুন পথ খোঁজার অন্বেষণই হবে বক্তব্যের বিষয় বস্তু। সমুদ্রের ঢেউ দক্ষ মোকাবেলায় শান্ত নাবিক রূপী আহমেদ ইকবাল হায়দারের সঞ্চালনা প্রশংসনীয়। প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নাট্যমেলার উদ্বোধনী দিন অভিনেতা আলী যাকের এবং সমাপনী দিন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের তির্যক সম্মাননা জ্ঞাপন গ্রহণ। আলী যা কেরের বক্তব্য হৃদয়স্পর্শী, চলচ্চিত্র না, টেলিভিশন না, আমার স্থান মঞ্চে কিন্তু অসুস্থতায় আসতে পারছিলাম না। এটা বেদনার কিন্তু আজ এলাম এটা আনন্দের। আশা, গ্যালিলিও নিয়ে ফিরব। অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘আসাদুজ্জামান নূরের মতো ব্যক্তি মঞ্চে আছেন জানলে আমার আসতে ভাল লাগে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা এবং রুচি তার মধ্যে অনন্য। ভাল লাগে হলভর্তি দর্শকদের উপস্থিতি, কেননা সেখান থেকে টের পাওয়া যায় দর্শকদের ভালবাসা’। তিন দিনব্যাপী তির্যক নাট্যমেলায় হলভর্তি দর্শকদের উপস্থিতি নিশ্চই আহমেদ ইকবাল হায়দার ও তার দলকে উপলব্ধি পাইয়ে দিয়েছে, তির্যক নাট্যমেলায় তির্যক পেয়ে ধন্য হলো নাট্যকর্মী- নাট্যানুরাগী এবং মিডিয়াকর্মীদের অফুরান প্রাণবন্ত ভালবাসা, যে ভালবাসা করণীয় কাজ সুসম্পন্নভাবে করার মধ্যে দিয়েই দেখা মেলে।
×