ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

আমি ডাকিতেছি তুমি ঘুমাইছ নাকি...

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

আমি ডাকিতেছি তুমি ঘুমাইছ নাকি...

এমন একজনের গভীর ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা যাকে ঘিরে আমাদের এখন কাটছে দিবা-রাত্রির জাগরণ। তিনি বারী সিদ্দিকী। শুদ্ধ সঙ্গীত অনুরাগী। গ্রামীণ লোকসঙ্গীত আধ্যাত্মিক ধারার গান যার কণ্ঠ বেয়ে উঠে এসে পৌঁচ্ছেছে আমাদের কর্ণকুহর হয়ে হৃদমাঝার অব্দি। একাধারে বংশী বাদক তিনি। তাঁর বাঁশির মোহনীয় সুরের ইন্দ্রজালে দিনের পর দিন আমরা মোহিত হয়েছি। তবে সময়ের বিচারে তাঁর সঙ্গে আমাদের জানা-শোনা বেশি দিনের নয়। ১৯৯৯ সালে নন্দিত কথা সাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয় সিনেমা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ যখন বাংলার অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে ভাললাগা এবং ভালবাসার গভীর অনুভূতি জাগায় তখন আমাদের হৃদমাঝারে একটা নাম স্পষ্ট হয়ে ওঠে বারী সিদ্দিকী! এ প্রসঙ্গে একটা কবিতার দুটি লাইন না লিখলেই নয় ‘জহুরি যে জহর চেনে/বেনেয় চেনে সোনা/সিন্ধুর জল-যে গিলেছে সেই বোঝে কত নোনা।’ গল্পের জাদুকর, সুচিত্র পরিচালক কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরেই আমরা এই নন্দিত সঙ্গীত অনুরাগীর দর্শন পেয়েছি। এবং প্রথম দর্শনে তিনি আমাদের সিক্ত করেছেন। বিশেষ করে তার গাওয়া ‘আমার গায়ে যত দুঃখসহ বন্ধুয়া রে কর তোমার মনে যাহা লয়’ প্রখ্যাত সুরকার গীতিকার বাঙালী সাধক উকিল মুন্সির এই গান বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে কি ভাবেই না মানুষকে আলোড়িত করেছে। এমনও দিন গেছে কেউ কেউ টানা পঞ্চাশ বার এই গান শুনেছেন। বিরহ জাগিয়ে গানের অতলে তলিয়েছেন। এই গানে প্রেম বিরহ যতটা স্পষ্ট ততটাই আধ্যাত্মবাদ উল্লেখ। বারী সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৫ নবেম্বর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বুক বেয়ে আসা সোমশ্বরী নদীর অববাহিকায়। যেখানে মনসুর বয়াতি, প্রখ্যাত বাউল রশিদ উদ্দিন, জালাল উদ্দিন খাঁ, উকিল মুন্সি, হুমায়ূন আহমেদ, জাফল ইকবাল ও প্রখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ’র মতো অনেক প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের জন্ম। এমন একটি পূর্ণভূমিতে জন্মের দায় থেকে মাত্র বার বছর বয়সে সঙ্গীত সাধনায় নেমে পরেন এই সঙ্গীত অনুরাগী। ওস্তাদ গোপাল দত্ত, পান্নালাল ঘোষ দবির খান সহ বেশসংখ্যক সঙ্গীতজ্ঞের সরাসরি সান্নিধ্য পান এই গুণী মানুষটি। সঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে বাঁশির প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ প্রেম। সমানে দুটেতেই সাধনা চালিয়েছেন। গানের প্রতি গভীর প্রেমে হয়েছেন দীর্ঘদিনের পরবাসী। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের পুনে গিয়ে থেকেছেন বেশ সময়। প-িত ভিজি কার্নাডের কাছে নিয়েছেন শাস্ত্রিয় তামিল। নব্বইয়ের দশকে দেশে ফিরে আসেন বারী সিদ্দিকী। দেশে ফিরে ঢাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে নিয়মিত বাঁশি বাজাতেন তিনি। নব্বইয়ের বছর তিনেক পর প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বারী সিদ্দিকীর বাঁশি শুনে তাঁর এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজানোর আমন্ত্রণ দেন। সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের দেখা । ওই অনুষ্ঠানে সেই সময়ের বেশ নামী-দামী গুণীজনেরা উপস্থিত ছিলেন। বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে বারী সিদ্দিকী গান ও শোনান। সকলে তার বাঁশির থেকে গানে মুগ্ধ হন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় তাঁর গাওয়া গানের উৎস কোথায়। তিনি বলেন, রশিদ উদ্দিন বাউল, উকিল মুন্সি। হুমায়ূন আহমেদে বললেন, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়,’ ‘পুবালি বাতাসে’ আমি এই গান রেকর্ড করতে চাই। তারপর গান স্টুডিওতে রেকর্ড হয়। দেশের অসংখ্য সিনেমা হলের মাইকে বেজে ওঠে বারী সিদ্দিকীর মনকাড়া সুরের গান। পরবর্তীতে তিনি পৌঁচ্ছে গেলেন দেশের অগণিত বেসুরো শিল্পীর গলায় গলায়। জীবনে বাকিটুকু অর্জন তাঁর যোগ্য মনিহার। গুণী এই মানুষটি গত শুক্রবার অসুস্থ হয়ে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। শুধু গান আর বাঁশি নয় বারী সিদ্দিকী ‘মাটির পিঞ্জিরা’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় এবং ‘পাগলা ঘোড়া’ নামে একটি নাটকে অতিথি চরিত্রে করেছেন। তাঁর হৃদয় নিংরানো সুর বাঁশি বাংলার বহু মানুষ বহুদিন তাকে মনে রাখবে।
×