ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারে ভূত, রিচার্জ করতেই কেটে নিচ্ছে টাকা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারে ভূত, রিচার্জ করতেই কেটে নিচ্ছে টাকা

রশিদ মামুন ॥ প্রিপেইড মিটারে বিল আদায়ের নামে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ডাকাতি শুরু করেছে। বিদ্যুতের দামের বাইরে ভ্যাট ছাড়াই রাষ্ট্রীয় বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিটি ২০ ভাগ বেশি অর্থ কেটে নিচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এর নির্ধারিত সীমার বাইরে অর্থ আদায় অন্যায় হলেও বিতরণ কোম্পানিটি গ্রাহকের সঙ্গে নতুন এই প্রতারণার খেলা শুরু করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ঢাকার মুগদা এলাকার এক বাসিন্দার মিটার নাম্বার ০২০২২০০৮১৬৩৬। পহেলা নবেম্বর গ্রাহক এই মিটারে ১০০০ টাকা রিচার্জ করেন। এখানে প্রিপেইড মিটারের বিল পরিশোধের কাগজে দেখা যায় এনার্জি কস্ট (মূল বিদ্যুতের দাম) দেখানো হচ্ছে ৭৫২ দশমিক ৩৮ টাকা। এখানে সার্ভিস চার্জ কাটা হয়েছে ২০ টাকা ডিমান্ড চার্জ নেয়া হয়েছে ৬০ টাকা মিটার ভাড়া নেয়া হয়েছে ১২০ টাকা। আর ভ্যাট ৫ ভাগ হারে নেয়া হয়েছে ৪৭ দশমিক ৬২ টাকা। এখানে বিদ্যুত ব্যবহারের আগেই গ্রাহকের কাছ থেকে ২৪৮ টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। ঠিক একইভাবে আজিমপুর এলাকার এক বাসিন্দা ডিডব্লিউ ২০০১৮০০৯ নাম্বার মিটারে গত ১৭ অক্টোবর এক হাজার টাকা রিচার্জ করেন। ওই গ্রাহকের মিটারে এনার্জি কস্ট দেখানো হয়েছে ৭৯২ দশমিক ৩৮ টাকা। ডিমান্ড চার্জ দেখানো হয়েছে ৬০ টাকা। সার্ভিস চার্জ নেয়া হয়েছে ২০ টাকা অন্যান্য চার্জ বাবদ দেখানো হয়েছে ৮০ টাকা। এছাড়াও ভ্যাট বাবদ নেয়া হয়েছে ৫ ভাগ হারে ৪৭ দশমিক ৬২ টাকা। এখানেও গ্রাহকের বিদ্যুত ব্যবহারের আগে কেটে নেয়া হয়েছে ২০৮ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহক যে পরিমাণ বিদ্যুত ব্যবহার করবে সেই টাকারই সে ভ্যাট প্রদান করবে। কিন্তু এখানে অতিরিক্ত ভ্যাট আদায়ের স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। গ্রাহকের কাছ থেকে ডিমান্ড, চার্জ সার্ভিস চার্জ এবং অন্যখরচ আদায় করা হচ্ছে তার ওপরও ভ্যাট কেটে রাখা হচ্ছে। প্রথম মিটারের ক্ষেত্রে এক হাজার টাকা রিচার্জে ৫ ভাগ হারে নেয়া হয়েছে ৪৭ দশমিক ৬২ টাকা। একই অঙ্কের অর্থ কাটা হয়েছে দ্বিতীয় মিটারের ক্ষেত্রে। পুরো এক হাজার টাকায় ৫ ভাগ হারে ভ্যাট কেটে নেয়া হলে তার পরিমাণ দাঁড়াত ৫০ টাকা। আবার শুধু মূল বিদ্যুত ব্যবহারের ওপর কাটা হলে দাঁড়ায় প্রায় ৪০ টাকা। কিন্তু ডিপিডিসি কোন ভিত্তিতে এই ভ্যাট কাটছে তাও স্পষ্ট নয়। আবার এখানে সার্ভিস চার্জের দ্বিগুণ আদায় করা হয়েছে। সাধারণত এ ধরনের এক ফেজ মিটারের বিদ্যুত ব্যবহারকারীর সার্ভিস চার্জ ১০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু নেয়া হয়েছে ২০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হয়তো কোন গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ বা ১৫০ টাকা অতিরিক্ত কেটে নেয়াকে খুব বেশি মনে হয় না। কিন্তু পুরো গ্রাহকের কাছ থেকে এভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করলে এর অঙ্ক শত শত কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ঢাকার আজিমপুর, লালবাগ, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় এক লাখ ১২ হাজার গ্রাহক ডিপিডিসির প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন। সরকারের পরিকল্পনা বলছে পর্যায়ক্রমে সব গ্রাহকে প্রিপেইড মিটার দেয়া হবে। বিইআরসি চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলামকে একটি বিলের কাগজ দেখিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন এবার আমরা এসব অন্যায় বন্ধের চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে বিইআরসির সকলের সহায়তা প্রয়োজন হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে বিদ্যুত ব্যবহারের আগেই বিল গ্রহণের পন্থা হিসেবে প্রিপেইড মিটার এর প্রচলন করছে। বিতরণ কোম্পানির সুবিধার জন্যই সারাদেশে প্রিপেইড মিটার বসানো হচ্ছে। কিন্তু প্রিপেইড মিটারে বিদ্যুত ব্যবহারের শুরুতেই বড় ধাক্কা খাচ্ছে গ্রাহক। কোন গ্রাহক এক হাজার টাকা প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করলে প্রথম সেকেন্ডেই তার কাছ থেকে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে। গ্রাহক বলছে কোন রকম বিদ্যুত ব্যবহারের আগেই বিরাট অঙ্কের টাকা কেটে নেয়াটা যৌক্তিক নয়। সম্প্রতি এই বিতরণ কোম্পানিটিই গ্রাহকের লোড বৃদ্ধির কথা বলে বিলের সঙ্গে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা শুরু করে। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে তারা এই পথ থেকে সরে আসে। কিন্তু অতিরিক্ত অর্থ যাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে তাদের সেই অর্থ ফেরত দেয়নি রাষ্ট্রীয় এই বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিটি। অনুন্ধানে জানা গেছে বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমাতে মিটার রিডারদের গরমে অতিরিক্ত বিল করে রাখার নির্দেশ ডিপিডিসিই অনানুষ্ঠানিকভাবে দিয়ে থাকে। আবার বছরের শেষে শীত এলে বিল কিছুটা কমিয়ে দিয়ে তা সমন্বয় করা হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মিটার রিডারদের বিল বাড়িয়ে করতে বলা হয়। জুনে বাৎসরিক হিসেব মিলিয়ে সিস্টেম লসের টার্গেট পূরণ হওয়ার পর আবার অতিরিক্ত বিল সমন্বয় করে দেয়া হয়। কিন্তু প্রিপেইড মিটারের ক্ষেত্রে এ ধরনের কারসাজির সুযোগ না থাকায় অতিরিক্ত আদায়ের খাত খোলা হয়েছে। বিদ্যুত বিলের ক্ষেত্রে এ ভাবে অর্থ আদায় আইনত দ-নীয় অপরাধ। এ ধরনের অভিযোগে ভোক্তারা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে অভিযোগ করতে পারেন। তবে অল্প টাকার জন্য কেউ এই ঝামেলায় যেতে চান না। কিন্তু এভাবে প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করলে বিপুল অঙ্ক জড়ো হয়। যে টাকার কোন হিসেব বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে দেখায় না কোন বিতরণ কোম্পানি। গ্রাহকের সঙ্গে এমন প্রতারণার অর্থ কী জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, এমন হওয়ার কথা না। এ সংক্রান্ত প্রমাণ থাকলে তার মেইলে পাঠানো সম্ভব কি না। তিনি বলেন, এ ধরনের কিছু হয়ে থাকলে তিনি দেখবেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মেইলে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রমাণপত্র পাঠালে ডিপিডিসি থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে একজন কর্মকর্তা ফোনে প্রতিবেদককে জানান এ ধরনের বিষয় নতুন প্রযুক্তির কারণে হচ্ছে। তার দাবি কোন নতুন প্রযুক্তির শুরুতে এ ধরনের সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু প্রিপেইড মিটার আদৌ কোন নতুন প্রযুক্তি নয় উল্লেখ করলে তিনি জানান সম্ভবত গত পহেলা নবেম্বর কোন সার্ভারে সমস্যা ছিল। এক নবেম্বরের আগে গত মাসেও ঠিক একইভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়েছে এবং তার আগেও একই অবস্থা কেন জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি। তিনি সংবাদ না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমরা গ্রহকের এই টাকা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করছি। এটাকে সফট ওয়্যার ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আইডিয়ালের ভুল উল্লেখ করেন তিনি। এই অতিরিক্ত অর্থ কী আইডিয়ালের কাছে থাকে না ডিপিডিসির হিসেবে জমা পড়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমাদের হিসেবেই জমা থাকে। ডিপিডিসি ছাড়াও ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির ৮৫ হাজার, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৬১ হাজার ৪১৭ নর্দান পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পনির ২০ হাজার ছাড়াও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহকরাও প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন। সরকার বলছে আগামী ৫ বছরের মধ্যেই সব গ্রাহক প্রিপেইড মিটারের আওতায় আসবে।
×