ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইন্দিরার শততম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ না করা আমাদেরও দীনতা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

ইন্দিরার শততম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ না করা আমাদেরও দীনতা -স্বদেশ রায়

১৯ নবেম্বর ইন্ডিয়ার এক সিনিয়র জার্নালিস্টকে জিজ্ঞেস করলাম, আজ ইন্দিরা গান্ধীর শততম জন্মদিন অথচ আপনাদের কোন সংবাদপত্রে এ নিয়ে কোন আয়োজন নেই কেন? কোন সংবাদ বা কোন বিশেষ লেখাও নেই। তিনিও একটু আশ্চর্য হলেন, বললেন তাই তো কংগ্রেস কিছু করল না কেন? এ নিয়ে আর খুব একটা কথা বলিনি, কারণ এমনিভাবে ভুলে যাওয়া বা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টার সঙ্গে পরিচয়টা আমাদের অনেক বেশি। তাছাড়া ওই শ্রদ্ধেয় জার্নালিস্ট ভদ্রলোকের কথাটা আরও মনকে ব্যথিত করল। অর্থাৎ কংগ্রেস কিছু করল না কেন? এ সুরটির সঙ্গেও আমরা পরিচিত। যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেননি, তখন বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ না করলে বলা হতো, আওয়ামী লীগ করল না কেন? আবার মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান জয়বাংলা বলেন না কেন, তখন বলা হয় ওটা আওয়ামী লীগ দলীয় সেøাগান বানিয়ে ফেলেছে। এসবের সঙ্গে আমরা অনেক বেশি পরিচিত। এই ভুলে থাকা, ভুলে যাওয়া, ভুলিয়ে দেয়ার রাজনীতিও আমাদের অনেক বেশি পরিচিত। এ কারণে এখানে একটি সফটওয়্যার নাড়াচাড়া করলেই আমরা গোটা প্রোগ্রামটা বুঝতে পারি। ১৯ তারিখে ভারতের প্রথম সারির পত্রিকা হিন্দুস্থান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এমনকি ভারতের গার্ডিয়ান বলে খ্যাত দি হিন্দুতেও ইন্দিরা গান্ধীর শততম জন্মদিন নিয়ে কোন সংবাদ দেখিনি। এমনকি কোন সংবাদ কোথাও খুঁজে পাইনি, ভারতের কোন বুদ্ধিজীবী মহল এ নিয়ে কোন প্রোগ্রাম করছেন। কংগ্রেস দিবসটি পালন করবে সে সংবাদও খুঁজে পাইনি। যদি কোথাও ছাপা হয়ে থাকে তাও গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থানে নয়। নিজের একটা প্রোগ্রাম বন্ধ করে যথেষ্ট সময় ব্যয় করে সংবাদপত্রগুলো খুঁজেছিলাম। তবে এর আগের দিন অর্থাৎ ১৮ তারিখে দি হিন্দুতে ইন্দিরাকে নিয়ে চমৎকার একটা লেখা ছাপা হয়। ইন্ডিয়ার সংবাদপত্রগুলো নিয়ে যখন এমনটি ভাবছিলাম, তখন বড় একটা লজ্জা নিজেকেও আঘাত করছিল বারবার। তাই ইন্টারনেটে বারবার খুঁজছিলাম বাংলাদেশের কোন সংবাদপত্র এ নিউজটি করেছে কি-না? সঙ্গে সঙ্গে অপরাধবোধে ভুগছিলাম, নিশ্চয়ই আমার অফিসকে ফোন করা উচিত ছিল, যেন ইন্দিরা গান্ধীর শততম জন্মদিন উপলক্ষে একটি লেখা ছাপে বা ইন্ডিয়ায় আসার আগে আমার একটা লেখা জোগাড় করে দেয়া উচিত ছিল। আবার মনে মনে ভাবছিলাম, এই সময়ে ড. আনিসুজ্জামান, মুনতাসীর মামুন ও শফিকুর রহমান ছাড়া ক’জনই বা ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে লিখতেন! কারণ, বেশি মানুষকেই দেখি তাঁরা খুব সুন্দর উপায়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন। যা হোক, ভারত ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে স্মরণ করেনি, সেটা ভারতের জনগণের ব্যর্থতা। ১৯৪৭-এর পরে ভারতকে বিশ্বসভায় নিয়ে গিয়েছিলেন প-িত জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে। জওয়াহেরলাল নেহরুর জ্ঞান এবং ব্যক্তিত্বের কারণে, তাঁর নীতির কারণে বিশ্ব দরবারে একটি সম্মানিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়া। যুদ্ধ উন্মাদ পৃথিবীতে, যুদ্ধের জোটগুলোর বাইরে বিশেষ করে জওয়াহেরলাল ও সুকর্ণের উদ্যোগে গড়ে ওঠা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনই পৃথিবীর ছবি বদলে দেয়। আর তার নেতা হিসেবে জওয়াহেরলাল নেহরু ও ভারত বিশ্বসভায় অন্য আসন পায়। জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে ইন্ডিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্ব সভায়। তার পরে বীরত্ব দিয়ে ইন্ডিয়াকে বিশ্বে আরেক আসন তৈরি করে দেন ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে। ১৯৭১ সালের ইন্দিরা একদিনে হননি। বাবা জেলে, মা জেলে। দেশজুড়ে বিদেশী পণ্য বর্জনের আন্দোলন চলছে। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে ভারত তখন তুঙ্গে। তখন বাড়িতে বিদেশী পণ্য পোড়ানো হচ্ছে আর একটি শিশু তার প্রিয় বিদেশী খেলনাটি নিজ হাতে এনে ছুড়ে দেন ওই আগুনে। সেই আগুন থেকেই বলা যেতে পারে শুরু আগুনে পোড়া ইন্ডিয়ার আয়রন লেডি ইন্দিরা গান্ধীর। ব্যক্তিগত কোন শোক, রাষ্ট্রীয় কোন দুর্যোগ, রাজনীতির কোন কঠিন দুর্গমপথে কোন সময়ই কেউ তাঁকে বিচলিত দেখেননি। চীনের বেঈমানীর পরেই প-িতজী মানসিকভাবে খুবই আঘাত পান। সেই থেকে তাঁর শরীর ভেঙ্গে যায়, আর ওই শরীর ভাল হয়নি। তাই অনেকটা অকালে মারা যান জওয়াহেরলাল নেহরু। তা না হলে অন্তত আরও পাঁচ সাত বছর খুব ভালভাবে ভারত এই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়কের সেবা পেতে পারত। জওয়াহেরলাল নেহরুর মৃত্যু কোন ছোটখাটো ঘটনা ছিল না। আজকের দিনে বসে হয়ত তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সেই আঘাত পেয়েও দেখা যাচ্ছে অবিচল এক ইন্দিরা। একা হাতে সামলাচ্ছেন পিতার মৃত্যুর পরবর্তী সবকিছুকে। সেই ধীরস্থির ইন্দিরার বর্ণনা মেলে আইকে গুজরালের আত্মজীবনীতে। ইন্দিরা শুধু সামলালেন না, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী করায়ও তিনি সমর্থন দিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে। তারপরে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীরও কেবিনেট মন্ত্রী থাকলেন তিনি। শাস্ত্রীর মৃত্যুর পরে কামরাজ, অতুল্য ঘোষ, ত্রিপাঠী প্রমুখ দিকপাল নেতারা সমর্থন দিলেন ইন্দিরাকে। ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হলেন। কিন্তু কারও হাতের পুতুল হলেন না। বরং ইন্ডিয়া দেখতে পেল এক নতুন নেতাকে। বিরল পরিশ্রমী এক নেতা। যিনি হাজার হাজার মাইল পথ ঘুরছেন দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের ভেতর। যার ফলে অতি অল্প সময়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুললেন, আরেক নতুন নেতা হিসেবে। যেখানে নেতা আর সাধারণ মানুষ। মাঝখানে কেউ নেই। কেঁপে গেলেন কংগ্রেসের বড় নেতারা। তাঁরা বেরিয়ে গেলেন অনেকে। কিন্তু ততদিনে সাধারণ মানুষের এক শক্তিশালী ‘মাইজী’ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন ইন্দিরা গান্ধী। যার ফলে বড় নেতারা কংগ্রেস ভাঙলেও তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন। রাজনীতির এই অধ্যায়ে এসে ইন্দিরা গান্ধীর দুই ধরনের সমালোচনা হতে পারে। এক. ইন্দিরা নিজেকে গড়ে তুললেন, সংগঠনকে নয়। যে কারণে তাঁর কংগ্রেস অর্থাৎ নবকংগ্রেস মূলত পরিচিত হলো ইন্দিরা কংগ্রেস হিসেবে। দুই. ইন্দিরা দেখতে পেলেন, সংগঠনের নামে বড় বড় নেতা তাঁকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন, তাঁকে কারও না কারও গ্রুপে থাকতে হয়। তাই তিনি সংগঠনকে এড়িয়ে নিজের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক গড়ে নতুন এক শক্তি নিয়ে আবিভূর্ত হলেন। এর কোন্টা ভাল সে আলোচনা এখানে নয়। প্রাসঙ্গিকও নয়। নতুন এই ইন্দিরা তাঁর নবকংগ্রেস নিয়ে জোট করলেন, সোভিয়েত ব্লকের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআইয়ের সঙ্গে। ’৭১-এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেন ইন্দিরা গান্ধী। যদিও বিজয় ছিল তাঁর দল নবকংগ্রেসের, কিন্তু বিজয়টি চিহ্নিত হলো ইন্দিরা গান্ধীর বিজয় হিসেবে। ইন্দিরা গান্ধী যখন তাঁর তরুণ তুর্কীদের নিয়ে ভারতে বিজয়ী হচ্ছেন তখন এই উপমহাদেশে তৈরি হচ্ছে আরেক নতুন ইতিহাস। ’৭০-এর পাকিস্তানের নির্বাচনে ততদিনে বিজয়ী হয়েছেন আরেক তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গীরাও প্রায় সবাই তরুণ তুর্কী। ’৭০-এর পাকিস্তানের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে স্থির হয়ে গেছে, পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নামে অর্থাৎ বাংলাদেশ নামে বেরিয়ে আসা তখন সময়ের বিষয় মাত্র। পাকিস্তানের সামরিক শাসক চাচ্ছে, জোর করে পূর্ব বাংলার মাটি রক্ষা করতে আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চাচ্ছেন, ওরা মাইনরিটি- ওরা বেরিয়ে যাক। বঙ্গবন্ধু তখন খেলছেন, রাজনীতির এক সুপার কূটনীতি (যা নিয়ে এখনও কোন গবেষণা হয়নি, অথচ পৃথিবীর রাজনৈতিক কূটনীতির ইতিহাসে এ এক মাইলস্টোন)। তিনি ইয়াহিয়াকে এমনভাবে খেলাচ্ছেন যাতে পৃথিবীর কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায়টা পড়ে ইয়াহিয়ার ঘাড়ে, আর মুজিব চিহ্নিত হবেন নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতার একমাত্র প্রতীক হিসেবে। সে কূটনীতিতে বঙ্গবন্ধু জিতে যান। ইয়াহিয়া আঘাত করে বাংলার সাধারণ মানুষের ওপর, বন্দী করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। অর্থাৎ গণহত্যাকারী, গণতন্ত্র হত্যাকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয় গোটা পৃথিবীতে ইয়াহিয়া। মুজিব তখন গণতন্ত্রের ও মানুষের নির্বাচিত নেতা ও একমাত্র প্রতীক। উপমহাদেশের রাজনীতির এই জটিল খেলায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পেছনে তখন আমেরিকা ও পরবর্তীতে চীন। তারপরেও তৎকালীন ভারতের দারিদ্র্যকে মাথায় রেখে উপমহাদেশের এই জটিল রাজনীতির খেলার এক বড় অংশ নিজ হাতে তুলে নিলেন ইন্দিরা গান্ধী। যারা ফুটবল খেলেন তারা বিষয়টি আমার থেকে ভাল বুঝবেন। আসলে উপমহাদেশের ওই সময়ের রাজনীতিটা বিশ্লেষণ করলে কেন যেন মনে হয়, বলটাকে গোলপোস্টের সামনে নিয়ে এসে নিশ্চিত গোলের জন্য মুজিব বলটা পাস দিলেন ইন্দিরার পায়ে। ইন্দিরা গান্ধী এই বলটা পাবার পরে খেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ও ভয় করেননি। এখানেই ছিল মুজিব এবং ইন্দিরার একাত্তরের বিজয়ের সব থেকে বড় দিক। দু’জনেই বলটা খেলেছেন বীরত্ব দিয়ে। আর বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। মানব সভ্যতার লাখো বছরের ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে দেখা যায়, বীরের সামনে কেউ টিকতে পারে না। দরিদ্র ভারতের নেতা ইন্দিরা গান্ধী তাই সেদিন শুধু বীরত্ব বা বীরের সাহসের ওপর ভর করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এক কোটিরও বেশি শরণার্থীর ভার নিল সেদিন একটি জনভারাক্রান্ত দরিদ্র দেশ ভারত। তার ওপর পাকিস্তানের সঙ্গে একটি অনিবার্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার নিশ্চিত বিষয়টি মাথায় নিয়ে। ইন্দিরা গান্ধীর সামনে সেদিন ভারতের অতীতের ব্যর্থতার এক ইতিহাস ছিল। যা ছিল তিব্বত এপিসোড। নেহরু ব্যর্থ হয়েছিলেন। দালাইলামা দেশহীন, দেশহীন তাঁর এক লাখ অনুগামী বা শরণার্থী। এই ব্যর্থতা থেকে বঙ্গবন্ধুও হিসাব করেছিলেন, তাই তিনি দালাইলামা হলেন না। তিনি নতুন পথ নিলেন। অর্থাৎ বিশ্বের বুকে প্রথম নির্বাচিত নেতা যাঁকে সামরিক বাহিনী বন্দী করে রেখেছে। অন্যদিকে ভারতের ওই অতীত ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী তৈরি করলেন তাঁর রণকৌশল। যার ভেতর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুটো দিক : এক. বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা। ১৪৮টির মতো দেশ সফর করলেন ইন্দিরা গান্ধী। তুলে ধরলেন, বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা। তুলে ধরলেন তাঁদের কাছে বাংলাদেশের নেতাকে জেলে বন্দী রাখার কথা। যার ফলে যে আমেরিকা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক শক্তি নিয়ে দাঁড়াতেও প্রস্তুত ছিল তাদের জনমত গেল বদলে। সে সময়ে যতদূর মনে পড়ে পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভবত ২৪টি প্রস্তাব এনেছিলেন নিক্সন, সিনেট তার ২২টি প্রস্তাবই বাতিল করে দেয়। ওই সময়ে অনেক সিনেটর প্রতিদিনই যোগ দিতে থাকেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিভিন্ন প্রোগ্রামে। এক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালী ও ভারতীয়দের অবদান যেমন, তেমনি ইন্দিরার সফর ছিল মাইলস্টোন। এরপরে ইন্দিরা গান্ধী যে কাজটি করেছিলেন তা হলো, দ্বি-পরাশক্তির বিশ্বে ভারত-সোভিয়েত সামরিক প্যাক্ট। এই দুই কাজ করেই ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সমর নেতাদের নিয়ে বসেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি সহায়তা করার জন্য। বিশ্বজনমত পক্ষে এনে এবং সোভিয়েত-ভারত প্যাক্ট করার ভেতর দিয়ে তিনি নিশ্চিত করেন, মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী এক হলেই অতি দ্রুত বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে। এর জন্য তিনি সেই সময়টি বেছে নেন, যখন ভারত-চীন সীমান্ত বরফের আস্তরণে ঢাকা। অর্থাৎ ন্যাচারাল গ্রেটওয়াল তৈরি হয়ে গেছে ভারতের জন্য। ফলে চীন সরাসরি অংশ নিতে পারবে না যুদ্ধে। আর আমেরিকা যদি নৌপথ ও আকাশপথে আসে তাহলে সেটা হবে বিশ্বযুদ্ধ- আঞ্চলিক যুদ্ধ নয়। আমেরিকার জনমত, আমেরিকার সিনেট সে যুদ্ধের অনুমোদন দেবে না। এই নিশ্চয়তা তৈরি করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শুরু ও ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি হন ইন্দিরা। কংগ্রেসের অনেক বড় নেতা, ভারতের অনেকেই তখনও ভয়ে কাঁপছিলেন, জড়ানো উচিত হবে কি আঞ্চলিক ও বিশ্বযুদ্ধের হুমকি মাথায় নিয়ে এই যুদ্ধে! কিন্তু ততদিন পৃথিবীর দুই মহাসাগর এসে মিলেছে এক মোহনায়। অর্থাৎ শেখ মুজিব ও ইন্দিরার বীরত্ব। যা হোক, কোন কূটনীতিতে ইন্দিরা ঠিকই তাঁর কাক্সিক্ষত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাতে পেরেছিলেন, তা ইতিহাসের ও কূটনীতির একটি রহস্যজনক অধ্যায়। তবে ইন্দিরা সফল হয়েছিলেন। এর পরে তাঁর যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সমর নায়ক ও তাঁর সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অনেকের আত্মজীবনী থেকে যা জানা যায়, তার সারমর্ম হলো, তাঁদের সকল যুদ্ধের হিসেব বদলে দেয় বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিবাহিনী। তাঁরা যেখান থেকে যে স্থানে ৪ দিনের ভেতর পৌঁছাবেন বলে মনে করেছিলেন, তা একদিনেই বাস্তবায়িত হয়ে যায় বাংলাদেশের জনগণের ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায়। যে কারণে ২২ ডিসেম্বরে তাঁদের ঢাকা ঘিরে ফেলার কথা থাকলেও ১৩ ডিসেম্বরে সে কাজ করতে পারে। তাই ১৬ ডিসেম্বরই শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই বিজয়ের আরেক নায়ক হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী তখন বিশ্ববুকে গ্রেট ইন্দিরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। দরিদ্র ভারতের নেতা তখন বিশ্বের অন্যতম ‘দি গ্রেট’ ইন্দিরা। ইন্দিরা কলকাতার সল্ট লেকের জনসভায়, লাল পেড়ে শাদা শাড়ি পরে অনেকটা অভয়দাত্রীর বেশে শরণার্থীদের সামনে উপস্থিত হয়ে দুটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন : এক. বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই এবং শরণার্থীরা সসম্মানে দেশে ফিরে যাবেন। দুই. মুক্ত-বিজয়ী শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসবেন তাঁর মানুষের কাছে। পশ্চিম পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর ট্রায়ালের নামে ফাঁসি দেয়ার উদ্যোগ শুরু হলে ইন্দিরা সেদিন গোটা বিশ্ব নেতাদের যেভাবে এ ট্রায়ালকে বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির কাজে লাগিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। ইন্দিরার দুটি প্রতিশ্রুতিই সঠিক হয়েছিল ১৯৭১ সালে। এর ভেতর দিয়ে পরাজিত হয়েছিল বিশ্ব পরাশক্তি আমেরিকা ও তাদের মিত্র অনেক আরব রাষ্ট্র। এই পরাজয়কে তারা মেনে নেয়নি। যে কারণে আরবের অর্থ আর আমেরিকার কূটনীতি ব্যয় হতে থাকে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করে এই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। শুধু প্রতিশোধ নয়, তৃতীয় বিশ্বে এমন দুই শক্তিশালী নেতা দাঁড়িয়ে যাওয়াও ছিল আমেরিকা ও তাদের পেট্রো-ডলার রাজনীতির জন্য মহাবিপদ। তাই পূর্ব খ- থেকে আইএসআই ও সিআইএ তাদের কার্যক্রম নিয়ে যায় পাঞ্জাব খণ্ডে। সিআইএ এবং আইএসআই মিলে তখন জোরদার করে তোলে পাঞ্জাবে ‘খালিস্তান’ আন্দোলন। আমেরিকা ও আরব রাষ্ট্রগুলোর অর্থে এই আন্দোলন এক সশস্ত্র অবস্থানে চলে যায়। যার জন্য ইন্দিরাকে নিতে হয় কঠোর সিদ্ধান্ত অর্থাৎ স্বর্ণমন্দির আক্রমণ। এভাবে খালিস্তান আন্দোলনের সেই বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি শক্তিশালী ওই নেত্রী। নিজ দেহরক্ষীর শিখ সৈন্যের হাতে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি জীবন দেন। তাঁর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে ভারতের রাজনীতির একটি অধ্যায় শেষ হয়ে যায়। এ অধ্যায় সম্পর্কে বিস্তারিত কোন কলামে লেখা সম্ভব নয়, বই আকারে লেখা যেতে পারে। অন্যদিকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত অনেক গোয়েন্দা রিপোর্ট মেলালে দেখা যায়, ইন্দিরা হত্যার এই পরিকল্পনা করে আমেরিকা ও পাকিস্তান ১৯৭১ এর পরাজয়ের পরেই। তাই বঙ্গবন্ধু যেমন ’৭১-এ আমেরিকাকে পরাজিত করে নিজে বাঁচতে পারেননি, ইন্দিরাও বাঁচতে পারেননি। কীভাবে তারা ইন্দিরাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এ নিয়ে পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছে রইল। যা প্রমাণ করবে ইন্দিরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদও। শিল্পী হুসেনের ছবির ভাষায় তিনি শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গর্ভযন্ত্রণা সহ্য করেননি, শেষ পর্যন্ত নিজে শহীদও হয়েছেন। তাই তাঁর শততম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ না করা আমাদেরও দীনতা। এ দীনতার জন্য কী বলা যায়, ‘এ দীনতা ক্ষমা করো !’ [email protected]
×