ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসা ব্যয় ও লাশ জিম্মি

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

চিকিৎসা ব্যয় ও লাশ জিম্মি

অসুস্থ মানুষকে আরও সুস্থতার পথে নিয়ে আসা হাসপাতালের মুখ্য কাজ। সুচিকিৎসা নিয়ে একজন রোগী যাতে বাড়ি ফিরে যেতে পারে, সেই সেবা শুশ্রƒষাটুকু নিশ্চিত করাই হাসপাতালের দায়িত্ব। সরকারী হাসপাতালে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য এমন যে, বহুমুখী অভিযান বহুবার চালিয়ে এদের নিবৃত্ত করা যায়নি। কারণ শর্ষেতেই ভূত। হাসপাতালের কর্মচারীদের যোগসাজশ এতই প্রসারিত যে, তাদের অপতৎপরতায় দালালরা দিব্যি দালালি করে যাচ্ছে। রাজধানীর সরকারী হাসপাতালগুলোতে বহিরাগত দালালদের উৎপাতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। প্রায় সব সরকারী হাসপাতালে দালালচক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের উপেক্ষা করে যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া রোগীদের পক্ষে অসম্ভব। বাধ্য হয়ে চিকিৎসার আশায় দালাল চক্রের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। তাদের দ্বারস্থ হলে সুচিকিৎসা মেলে। না হলে অবহেলার শিকার হতে হয়। দালালদের অর্থ না দিলে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা পাওয়া দুষ্কর, দালালচক্রের মাধ্যমে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের একটি প্রভাবশালী চক্র বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে রোগীদের তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে চিকিৎসার নামে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এভাবে চিকিৎসা সেবাকে তারা লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। বড় হাসপাতালগুলোর আশপাশেই গড়ে উঠেছে প্রাইভেট ক্লিনিক। তাদের উপার্জনের একটা বড় অংশের যোগান দিচ্ছে দালালচক্র। সরাসরি হাসপাতালে রোগী হিসেবে চিকিৎসা নিতে যারা যান, তারা সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষ। আর বেসরকারী হাসপাতালে দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় অন্যতর দুর্ভোগ। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে রোগীর অর্থনাশের পথ ও পন্থা তৈরি করে প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক উপার্জন করছে। কোন কোন হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় অত্যধিক, সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে অনেক সময় রোগী চিকিৎসা ব্যয় পরিশোধ করতে পারে না। জমিজমা ঘরবাড়ি বিক্রি করে চিকিৎসা ব্যয় চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার নামে অর্থ হাতানোর এক পরিক্রমা চলে। এ জন্য কোন জবাবদিহি করতে হয় না। এ যেন ‘ ‘খেয়াল খুশির এক রাজ্য।’ আর চিকিৎসা ব্যয় পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে কোন কোন ক্লিনিক রোগীকে আটকে রাখে। এমনকি অত্যাচার এবং নির্যাতন চালায়। রোগীর অপারেশনের প্রয়োজন না হলেও তা করে অধিক অর্থ আদায়ের লোভে। এই অর্থ অসচ্ছল রোগীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব না হলে ঘটে বিপত্তি। ধার-দেনা বা জমিজমা বিক্রি করে পরিশোধ করতে হয় হাসপাতালের বিল। সবচেয়ে জঘন্য যে ব্যাপারটি ঘটে আসছে, তা হলো, চিকিৎসা ব্যয় পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে কোন ক্লিনিক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অসচ্ছল ব্যক্তির লাশ আটকে রাখে। লাশ জিম্মির এই ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। ঢাকার সিটি হাসপাতাল ২০১২ সালের ৮ জুন অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় একটি শিশুর লাশ হস্তান্তর করেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশুটির মৃত্যুর পর ২৬ হাজার টাকা বেশি বিল দাবি করে লাশ হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এই নিয়ে একজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছে অসচ্ছল ব্যক্তির লাশ জিম্মি করা যাবে না। একই সঙ্গে ওই চিকিৎসা ব্যয় পরিশোধে একটি তহবিল গঠন করতে স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই তহবিলের অর্থ বিল পরিশোধে অক্ষম গরিব রোগীদের চিকিৎসার খরচ পরিশোধ করতে হবে। আর শিশুর লাশ জিম্মিকারী হাসপাতালকে জরিমানা করা হয়েছে। আদালত একটি যুগান্তকারী নির্দেশ প্রদান করেছে বলা যায়। দরিদ্র রোগীদের জন্য যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির উদ্ভব হতো তা এখন নিরসন হবে। আদালতের নির্দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথাযথভাবে অবলম্বন করলে অসচ্ছল, গরিব রোগীরা অমানবিক আচরণ থেকে মুক্তি পেতে পারে। আদালতের নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল আরও আগে এই ব্যবস্থা নেয়া। আশা করি তারা কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
×