ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

লেবাননকে আরেক সংঘাতে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২২ নভেম্বর ২০১৭

লেবাননকে আরেক সংঘাতে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র

সৌদি আরব লেবাননকে ইরানের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর জন্য সেদেশের সরকারের পতন ঘটিয়েছে। গত ৪ নবেম্বর সৌদি আরবে শুদ্ধি অভিযানের একই দিনে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি টেলিভিশনে হাজির হয়ে তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কারণ হিসেবে তিনি তার জীবন বিপদাপন্ন হওয়ার কথা জানান এবং ইরান ও এর শক্তিশালী লেবাননী মিত্র হিজবুল্লাহর তীব্র সমালোচনা করেন। তার পাঠ করা বিবৃতিটির পেছনে যে সৌদি আরবের হাত ছিল তাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। তাঁর ঘোষণাটা রিয়াদে রেকর্ড করা হয়। তারপর সৌদি চ্যানেলে পরিবেশন করা হয়। এরপর থেকে হারিরি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। তিনি সৌদি প্রহরায় আছেন এবং সম্ভবত তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এ ঘটনার কদিন আগে সৌদি আরবের উপসাগর বিষয়কমন্ত্রী খামের আল সাবহান শিয়া মিলিশিয়া ও রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহকে উৎখাতের লক্ষ্যে লেবাননে বিস্ময়কর কিছু ঘটনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রথম দৃষ্টিতে দেখলে সৌদি আরবে জন্ম নেয়া সুন্নি সাদ হারিরিকে উৎখাতের পেছনে সৌদি আগ্রহ বোধগম্য হবার কথা নয়। সৌদি আরব ও আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে হারিরিকে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ হিসেবে সমর্থন দিয়ে আসছিল। গত ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর হারিরি ২০০৫ সালের পর থেকে লেবাননের প্রথম বাজেট পাস করেন এবং ২০০৯ সালের পর থেকে প্রথম পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সকল পক্ষের মতৈক্য আদায় করেন। লেবাননের পর্যটনে গতি আসছিল। উপকূলীয় তেল প্রকল্পগুলো নিয়ে চুক্তি হবার কাজ চলছিল। হারিরি এভাবে বিদায় নেয়ার ফলে সৌদি আরব এখন লেবানন সরকারকে ইরান ও তার শিয়া প্রক্সি হিজবুল্লাহর তাঁবেদার বলে ঘোষণা করতে পারে। ১৯৮৯ সালে যে তায়েফ চুক্তি বলে লেবাননের দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল তাতে হিজবুল্লাহ বাদে সকল সম্প্রদায়ের মিলিশিয়াদের নিরস্ত্র করা হয়েছিল। হিজবুল্লাহ অব্যাহতি দেয়ার যৌক্তিকতা ছিল এই যে ওরা তখন লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে তাদের স্বাক্ষরিত নিরাপত্তা অঞ্চলের ওপর ইসরাইলের দখলদারির বিরুদ্ধে লড়ছিল। কিন্তু ২০০০ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার পর থেকে হিজবুল্লাহকে অস্ত্র সমর্পণ করানোর জন্য যত রকমের রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে প্রতিটি উদ্যোগই গ্রুপটি ব্যর্থ করে দিয়েছে। সাদ হারিরির পিতা রফিক হারিরি বেশ জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন। অভিযোগ আছে তার হত্যাকা-ে হিজবুল্লাহ জড়িত। ২০০৬ সালে এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে ইসরাইল হিজবুল্লাহকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিল। সে যুদ্ধ অচলাবস্থার মধ্যে শেষ হয়। তারপর থেকে গ্রুপটি দক্ষিণে তার চৌহদ্দী ছড়িয়ে এলাকা আরও প্রসারিত করার চেষ্টা করে। ২০০৮ সালে হিজবুল্লাহ মিলিশিয়ারা রাজধানী বৈরুত অল্প কিছুদিনের জন্য দখল করেও রেখেছিল। এদের হাজার হাজার জঙ্গী সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সুন্নি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়েছে। সেই লড়াইয়ে পোড় খাওয়া যোদ্ধারা ফিরেও এসেছে। এ বছরের গোড়ার দিকে লেবাননের পর্বতময় উত্তরাঞ্চলের সুন্নি অধ্যুষিত এলাকায় জিহাদীরা আইএসএর কালো পতাকা উড়ানোর পর হিজবুল্লাহ মিলিশিয়ারা সেখানে তাদের পরাজিত করে। এখন হিজবুল্লাহর গুপ্ত পুলিশ বিরুদ্ধবাদীদের খুঁজে বের করছে। এদের যোদ্ধারা ব্যাহত নিরপেক্ষ লেবাননী সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। সেনাবাহিনীসহ দেশের অন্য আর কোন শক্তি এদের সমকক্ষ নয়। এ অবস্থায় সৌদি আরব হিজবুল্লাহকে উৎখাতের কথা বলছে কেন? সম্ভবত রিয়াদ লেবাননে একটা যুদ্ধ চাচ্ছে। তারা মনে হয় ঠিক করছে যে ইরানকে মোকাবিলা করার সর্বোতম উপায় হচ্ছে লেবাননে ইরানের প্রক্সি হিজবুল্লাহকে মোকাবিলা দিয়ে শুরু করা। আর সেটা করার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য হারিরিকে সরানোর দরকার হয়ে পড়েছিল। লেবানন সরকার একটা কোয়ালিশন সরকার যার মধ্যে হিজবুল্লাহও অংশীদার। হারিরি ছিলেন সৌদি সমর্থপনপুষ্ট। এখন হারিরি সরে যাওয়ার পর সৌদি আরব লেবাননকে হিজবুল্লাহর আধিপত্য পুষ্ট ইরানী চৌকি বলে চিহ্নিত করতে পারবে। এটা হতে পারে ভবিষ্যতের বেশ কিছু কার্যক্রমের মধ্যে প্রথম একটি চাল। সেই কার্যক্রমের সবার শেষে থাকবে ইসরাইল হিজবুল্লাহ সশস্ত্র সংঘর্ষ। আর সেই সংঘর্ষের পরিণতিতে হিজবুল্লাহ নিশ্চিহ্ন হতে এবং এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব খর্ব হতে পারে। সুতরাং হারিরির অপসারণ হিজবুল্লাহর জন্য একটা ফাঁদ বিশেষ। সেই ফাঁদে ধরা দিয়ে হিজবুল্লাহ যদি লেবাননে নিজ ক্ষমতার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটায় ও পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে তাহলে লেবাননকে একটা সন্ত্রাসী সংগঠন দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো যাবে এবং শেষ পর্যন্ত সেখানে ইসরাইলী হামলার পথ রচনা করে দেয়া হবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×