ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক

প্রাইমারীর প্রথম দুই পরীক্ষাতেই অনুপস্থিত ৩ লাখ খুদে শিক্ষার্থী

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২২ নভেম্বর ২০১৭

প্রাইমারীর প্রথম দুই পরীক্ষাতেই অনুপস্থিত ৩ লাখ খুদে শিক্ষার্থী

বিভাষ বাড়ৈ ॥ পাবলিক পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন ও শিক্ষার্থী বহিষ্কারের সংখ্যা কমলেও ক্রমশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কেন্দ্রে অনুপস্থিতির সংখ্যা। নকলমুক্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে জেএসসি ও জেডিসির পর চলছে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা। দুই পরীক্ষাতেই অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের কম সংখ্যা সকলের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু কমছে না ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেও প্রতিদিনই পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত থাকছে হাজার হাজার পরীক্ষার্থী। প্রাথমিকে প্রথম দুই পরীক্ষাতেই অনুপস্থিত তিন লাখ শিশু! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা পরীক্ষাতে আসছে না তাদের একটি বড় অংশই শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। নকল বন্ধে বহিষ্কারের সংখ্যা কমলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে এই অব্যাহত ঝরে পড়ার বিশাল সংখ্যায় উদ্বিগ্ন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার আগের তুলনায় কমছে এ কথা সত্য কিন্তু কোনভাবেই কমানো যাচ্ছে না হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এই সংখ্যা এখনও আছে উদ্বেগজনক পর্যায়েই। বিশেষজ্ঞরা ঝরে পড়া ও হলে অনুপস্থিত থাকার কারণ চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আর্থিক সঙ্কটসহ নানা কারণে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনীর আগেই তারা ঝরে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছরের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষাতে দেখা যায়, অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রতিদিনই কমেছে। কিন্তু কমেনি ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের ৮টি সাধারণ ও একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার প্রথম দিনে বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ জন। কিন্তু ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি ৫৯ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় দিনে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কার হয় ২৩ জন। কিন্তু অনুপস্থিত ছিল ৬২ হাজার ৩১৮ জন। তৃতীয় দিন ইংরেজী প্রথম পত্র পরীক্ষায় ২৭ জন বহিষ্কার হলেও অনুপস্থিত ছিল ৬০ হাজার ৬৯৮ জন। ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় বহিষ্কার হয় ৪৬ জন আর অনুপস্থিত ছিল ২৮ হাজার ৫১৮ জন। ধর্ম পরীক্ষায় বহিষ্কার হয় ৩৩ জন, অনুপস্থিত ছিল ৫৭ হাজার ৬৯৪ জন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষায় বহিষ্কার হয় ৮ জন। কিন্তু কেন্দ্রে আসেনি ৫৬ হাজার ৪৪৬ জন। বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় পরীক্ষায় বহিষ্কার হয় ১০ জন, কিন্তু নিবন্ধন করেও পরীক্ষা কেন্দ্রে আসেনি ৫৭ হাজার ৪৪ শিক্ষার্থী। এ তো গেল গত বছরের কথা। চলতি বছরের চিত্রও ছিল প্রায় একই। এবার জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা সম্প্রতি শেষ হয়েছে। তবে পরীক্ষার প্রথম দিনেই ৬০ হাজার ৮৯৩ পরীক্ষার্থী কেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিল। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে ১৫ পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয় ওই পরীক্ষায়। দ্বিতীয় দিনে কেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিল ৬১ হাজার ৯৮৯ পরীক্ষার্থী। অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে ২০ পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই হারে অন্যান্য পরীক্ষাতেও ছিল অনুপস্থিতি। অন্যদিকে অনুপস্থিতির হার অনেক বেশি প্রাথমিক স্তরে। গত বছর প্রাথমিক ও ইবেতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষার প্রথম দিনের পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৩১৬ জন। দ্বিতীয় পরীক্ষাতেও অনুপস্থিত ছিল এক লাখ ১৬ হাজার শিশু শিক্ষার্থী। এই মুহূর্তে চলছে এবারের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা। গত রবিবার থেকে এ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত বড় কোন সঙ্কট ছাড়াই চলছে এ পরীক্ষা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, এখন পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁসের মতো কোন খারাপ খবর নেই। যা হচ্ছে তা গুজব। কিন্তু অনুপস্থিতির হার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছেই। পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম দুদিনের পরীক্ষাতেই কেন্দ্রে অনুপস্থিত তিন লাখ শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় দিনে বাংলা পরীক্ষাতে নিবন্ধন করে কেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিল এক লাখ ৪৬ হাজার শিক্ষার্থী। এর আগে রবিবার প্রথম দিন ইংরেজী পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার পরীক্ষার্থী। এ পরীক্ষার জন্য এবার নিবন্ধন করেছে ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫ জন খুদে শিক্ষার্থী। যার মধ্যে প্রাথমিকে ২৮ লাখ চার হাজার ৫০৯ জন এবং মাদ্রাসার ইবতেদায়িতে দুই লাখ ৯১ হাজার ৫৫৬ জন। প্রাথমিক সমাপনীর নিবন্ধন করা ২৮ লাখ চার হাজার ৫০৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যা ছাত্রদের চেয়ে বেশি। ছাত্র ১২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৫ জন ও ছাত্রী ১৫ লাখ চার হাজার ৫২৪ জন। ছাত্রের চেয়ে ছাত্রী সংখ্যা এক লাখ ৮৯ হাজার ৮০১ জন বেশি। দুই পরীক্ষায় গত বছর মোট ৩২ লাখ ৩০ হাজার ২৮৮ জন অংশ নিয়েছিল। সে হিসেবে এবার পরীক্ষার্থী কমেছে এক লাখ ৩৪ হাজার ২১৩ জন। ২০১৫ সালে ৩২ লাখ ৫৪ হাজার ৫১৪ জন খুদে শিক্ষার্থী এই সমাপনীতে অংশ নিয়েছিল। পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয় ২০০৯ সালে। আর ইবতেদায়ি পরীক্ষা শুরু হয় ২০১০ সালে। প্রথম দুই বছর বিভাগভিত্তিক ফল প্রকাশ করা হয়। ২০১১ সাল থেকে গ্রেডিং পদ্ধতিতে এই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হচ্ছে। ২০১৩ সাল থেকে এই পরীক্ষার সময় আধ ঘণ্টা বাড়িয়ে আড়াই ঘণ্টা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না, তাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা প্রায় শতভাগ। তবে শিক্ষাবোর্ড ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই আগামী বছর পরীক্ষা দেবে। তবে অনুপস্থিতির ব্যাপক হার ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কেবল নকল কমালেই শিক্ষার লক্ষ্য পূরণ হবে না। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিশ্চিত করে রোধ করতে হবে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার। শিক্ষার্থীদের এই অব্যাহত ঝরে পড়ার পরিস্থিতিকে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার পথে অন্তরায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বছরের পর বছর এভাবে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে নানা কারণে। প্রধান কারণ হিসেবে বলছেন, পুরোপুরি অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত না করায় অষ্টম শ্রেণীতে যাওয়ার আগেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া, অসচেতনতার জন্য বাল্যবিয়ে, দারিদ্র্য, নদীভাঙ্গন, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতাও রয়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলছিলেন, টানাপোড়েনের সংসারে ছেলেদের পাঠানো হচ্ছে কাজে আর নিরাপত্তার কারণে মেয়েদের আগেই স্কুল থেকে সরিয়ে নিয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন করতে হলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে শিক্ষাকে। আর তা দ্রুত সম্ভব না হলে ঝরে পড়া কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই। বন্ধ করতে হবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলছিলেন, ভর্তির হার এখন আশাব্যঞ্জক। তবে ঝরে পড়া রোধ করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করে এখনই ঝরে পড়া কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভর্তির পর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে সচ্ছলতা আনতে অভিভাবকরা স্কুল থেকে বাচ্চাদের সরিয়ে নিচ্ছেন। সে কারণেই বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে নবম শ্রেণী পর্যন্ত। তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর অকৃতকার্য শিক্ষার্থী পরবর্তীতে উত্তীর্ণ হচ্ছে সত্য। বিদ্যালয়ে ভর্তির হারও আশাব্যঞ্জক, তবে প্রাথমিক সমাপনীতে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার যে তফাত, তা আসলে উদ্বেগজনকই। এ বিষয়ে সরকারের ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
×