ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভর্তি হওয়া ঢাবির ৭ ছাত্র আটক

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কয়েক ধাপে, কাট আউট পদ্ধতিতে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২২ নভেম্বর ২০১৭

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কয়েক ধাপে, কাট আউট পদ্ধতিতে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পরীক্ষায় জালিয়াতি করে ভর্তি হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত ছাত্রকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। আটককৃতরা বিশেষ ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। এ নিয়ে ১৪ ছাত্র সিআইডির হাতে গ্রেফতার হলো। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েক ছাত্রকে পরীক্ষায় অসাধুপায় অবলম্বনের দায়ে সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে প্রশ্নপত্র ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে পাঁচজন। জবানবন্দীতে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া অনেক শিক্ষার্থী সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সেসব শিক্ষার্থীর বিষয়ে তদন্ত চলছে। মঙ্গলবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের সিআইডি কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃতরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। মঙ্গলবার দুপুরে সিআইডির বিশেষ পুলিশ (এসএস) সুপার মোল্যা নজারুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, অভিযানে গ্রেফতার করা হয় তানভীর আহমেদ মল্লিক, বায়োজিদ, নাহিদ ইফতেখার, ফারদিন আহমেদ সাব্বির, প্রসেনজিৎ দাশ, রিফাত হোসাইন ও আজিজুল হাকিমকে। গ্রেফতারকৃতদের ভর্তি করানোর অভিযোগে গত ১৪ নবেম্বর রংপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাভিদ আনজুম তনয়কে (২৪) গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একই চক্রের সদস্য উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী এনামুল হক আকাশকে গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতে পাঠানোর পর তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সেখানে জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের নাম জানায় তারা। চক্রটি গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৪ থেকে ৭ লাখ টাকা করে নিত বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। সিআইডি সূত্র জানায়, চক্রটির প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় চলতি বছরের ১৯ অক্টোবর। ওইদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল ও ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল থেকে অভিযান চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহীউদ্দিন রানা ও আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তাদের স্বীকারোক্তিতে জালিয়াতিচক্রের অন্যতম হোতা তনয়ের নাম প্রকাশ পায়। এরপর গত ১ নবেম্বর আগারগাঁও থেকে একই চক্রের সদস্য নাফিকে আটক করা হয়। এরপর ৩ নবেম্বর আটক করা হয় একই চক্রের সদস্য আনিনকে। তনয় ও আকাশের জবানবন্দীতে সাত ছাত্রের নাম আসে। তনয়ের কাজ ছিল পরীক্ষার্থী জোগাড় করা। সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম জানান, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কয়েকটি ধাপে। জঙ্গীদের মতো কাট আউট পদ্ধতিতে ধাপগুলো সাজানো হয়। এ চক্রের সঙ্গে জড়িতরা একজন আরেকজনকে সরাসরি চেনে না। শুধু মোবাইল ফোন বা প্রযুক্তিগতভাবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রথম প্রক্রিয়া শুরু হয় পরীক্ষার হল থেকে। আগে পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ করতে পারত। তখন পরীক্ষার্থীরা নিজেরাই প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে তা বাইরে পাঠিয়ে দিত। পরবর্তীতে পরীক্ষার্থীদের হলে মোবাইল ফোন বা প্রযুক্তিগত কোন ডিভাইস বহন নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর শুরু হয় পরীক্ষার হলে দায়িত্বপালনকারীদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রক্রিয়া। পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনকারীদের অনেকেই এক চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকে। তারা প্রশ্নপত্র পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীদের কাছে দেয়া মাত্র বা দেয়ার আগে ছবি তুলে রাখে। ছবি তুলে তা পাঠিয়ে দেয় বাইরে থাকা একটি চক্রের কাছে। চক্রটি মূলত সলভার হিসেবে পরিচিত। এই সলভাদের অধিকাংশই বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বুয়েট ও মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তারা দ্রুত প্রশ্নটি সমাধান করে। এরপর তারা বিশেষ এ্যাপসের মাধ্যমে আরেকটি চক্রের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এই চক্রটির নাম প্রেজেন্টার। এই প্রেজেন্টারের সংখ্যা এক বা একাধিক হতে পারে। এরপর প্রেজেন্টাররা সরাসরি প্রশ্নের নম্বর বলে তার উত্তর বলে দিতে থাকে। আর এই চক্রের সঙ্গে আগ্রহী পরীক্ষার্থীরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সংযুক্ত হয়। যারা এই চক্রের সুবিধা নেবে, তাদের কাছে মাস্টারকার্ড বা কোন ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মতো একটি কার্ড দেয়া হয়। এই কার্ডের ভেতরে বসানো থাকে বিশেষ ডিভাইসটি। এই কার্ড দেখলে কারও সন্দেহ করার কোন সুযোগ নেই। কারণ কার্ডগুলোর অধিকাংশই কোন না কোন ব্যাংক বা কোন সুপার সপের নামে করা হয়ে থাকে। এতে হলে দায়িত্বপালনকারীদের অধিকাংশই এটিকে মাস্টারকার্ড বা এটিএম কার্ড ভেবে ভুল করে থাকেন। এই কার্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে একটি হেয়ার ডিভাইজ। হেয়ার ডিভাইসটি খুবই ছোট। তা অনায়াসে কানের ভেতরের দিকে বসিয়ে রাখা যায়। বাইরে থেকে সহজেই তা চোখে পড়ার কোন সুযোগ নেই। প্রেজেন্টাররা প্রশ্নের উত্তর বলতে থাকে আর পরীক্ষার্থীরা তা শুনে খাতায় উত্তর লিখতে থাকে। এতে পরীক্ষা ভাল হয়। চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। ঠিক এভাবেই গ্রেফতারকৃত সাত ছাত্র ২০১৬ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। যথারীতি তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস করছিল। দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সিআইডি পুলিশ বিষয়টির তদন্ত করছিল। অবশেষে তার সুফল মিলেছে। গ্রেফতারকৃতরা অনেক শিক্ষার্থীর নাম প্রকাশ করেছে। যাদের নাম প্রকাশ করেছে, তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির মধ্যে অবৈধপথ অবলম্বন করে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে তাদের অপরাধ প্রমাণিত হলেই তাদের গ্রেফতার করা হবে। তাদের সার্বিক গতিবিধি গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তবে কতজনের বিষয়ে তদন্ত চলছে তা তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা যাচ্ছে না। গ্রেফতারকৃতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব থাকা না থাকার বিষয়টি নির্ভর করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও আদালতের ওপর। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির পথ অবলম্বন করার শাস্তি দুই থেকে পাঁচ বছর কারাদ- বলেও জানান সিআইডি কর্মকর্তা মিনহাজুল ইসলাম। গ্রেফতারকৃতদের অনেকেই ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় দিত। যদিও ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, তারা ক্ষমতাসীন দলের কেউ নয়। পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতাসীন দলকে হেয় করতেই তারা আটকের পর ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে বাড়তি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে। গ্রেফতারকৃতরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী কিনা সে সম্পর্কে তদন্তে কোন তথ্য মেলেনি বলে জানিয়েছেন সিআইডি কর্মকর্তা মিনহাজুল ইসলাম।
×