ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা প্রণয়ন

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২১ নভেম্বর ২০১৭

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা

নিখিল মানখিন ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জরুরী চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ‘জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা-২০১৭’-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে সরকার। এ নীতিমালার আওতায় আহত ব্যক্তির আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও সরকারী-বেসরকারী সব হাসপাতালে দ্রুত জরুরী চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের সহায়তা করতে গিয়ে সাহায্যকারী ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন, নীতিমালায় সে নির্দেশনাও রয়েছে। আহত ব্যক্তির স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানি কমাতেই ওই নীতিমালা করা হলো। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মোঃ সিরাজুল খান স্বাক্ষরিত এ নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রণীত এ নীতিমালাটির ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা-২০১৭’ নামকরণ করা হয়। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এ্যান্ড রিসার্চের তথ্যানুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে বছরে ২৩ হাজারেরও বেশি মৃত্যু ও ৩৫ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু আহত হয়। আর্থিক ক্ষতি বিবেচনায় বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। সড়ক মহাসড়কে কারিগরি ত্রুটি, যানবাহন চলাচলে অনিয়ম, চালকের অদক্ষতা, জনসচেতনতার অভাব ও সড়ক-মহাসড়কে চলাচল উপযোগী নিরাপদ যানবাহনের অভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির জরুরী চিকিৎসা আবশ্যক হলেও তারা যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পান না। বিভিন্ন ছোট-বড় হাসপাতাল বিশেষ করে বেসরকারী হাসপাতালগুলো নানা অজুহাতে দুর্ঘটনার শিকার রোগীদের অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করে। আহত ব্যক্তি যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, বিকলাঙ্গ বা পঙ্গুত্ববরণ করেন, এমনকি তাদের মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১১ অনুসরণ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের সংখ্যা হ্রাস, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানের সুপারিশ সর্বোপরি হাইকোর্টের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরী স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে এ নীতিমালা প্রণীত হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জরুরী স্বাস্থ্যসেবা প্রদান নিশ্চিত করতে নীতিমালায় বলা হয়, হাসপাতাল স্থাপনের অনুমোদন প্রদানের আগে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, জনবল ও জরুরী চিকিৎসা সরঞ্জামাদিসহ জরুরী বিভাগ স্থাপনের শর্ত আবশ্যিকভাবে প্রতিফলন করতে হবে। ইতোমধ্যে স্থাপিত হাসপাতালের অনুমোদন/ নিবন্ধন/ লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে ওই শর্ত পালন নিশ্চিত করতে হবে। আহত ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। হাসপাতালে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে হবে। আইনী জটিলতার সম্ভাবনা বিবেচনায় চিকিৎসাসেবা প্রদানে বিলম্ব করা যাবে না। আহত ব্যক্তির আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা না করে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। প্রণীত নীতিমালায় আরও বলা হয়, চিকিৎসা প্রদানে সক্ষমতাসম্পন্ন হাসপাতাল কোন অবস্থাতেই রোগীর চিকিৎসা প্রদান না করে ফেরত বা অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করকে পারবে না। জরুরী চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি অবহেলা কিংবা শৈথিল্য প্রদর্শন করলে তা অসদাচরণ বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবহেলা বা শৈথিল্য প্রদর্শন করলে নিবন্ধন/লাইসেন্স/অনুমতি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আহত ব্যক্তির অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে স্বজন বা আত্মীয় না থাকলেও চিকিৎসক প্রাণ বাঁচাতে অস্ত্রোপচার করবেন। এক্ষেত্রে রোগী মারা গেলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যাবে না ইত্যাদি। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, দেশের বেশিরভাগ বেসরকারী হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। ফলে এসব সেবাকেন্দ্রে দুর্ঘটনায় আহতদের নিয়ে গেলেও জরুরী চিকিৎসাসেবা মেলে না। অনেক হাসপাতাল আবার ঝামেলা এড়াতে দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা দিতে আগ্রহী থাকে না। আবার কোন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা দেয়ার আগেই টাকা জমাদানের নির্দেশ দিয়ে থাকে। কোন কোন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জরুরী বিভাগই নেই। এদিকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে আবার কোন কোন হাসপাতাল নামকাওয়াস্তে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সরকারী হাসপাতালে স্থানান্তর করে দেয়। এতসব অনিয়মের ফাঁদে পড়ে জরুরী চিকিৎসাসেবা পান না রোগীরা। কিন্তু এসব অনিয়মের বিষয়ে জানলেও আইনের ফাঁকফোকর থাকায় কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাসপাতালের জরুরী বিভাগগুলোকে মানসম্পন্নভাবে তৈরি এবং আধুনিকায়ন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে মানসম্মত জরুরী বিভাগ নেই। আবার জরুরী বিভাগ থাকলেও জরুরী চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, দক্ষ নার্স, টেকনিশিয়ান ও যন্ত্রপাতি নেই। তাই এ বিষয়ে সরকারের একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে। জরুরী বিভাগে কী ধরনের যন্ত্রপাতি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সসহ সাপোর্টিং কর্মচারী কারা থাকবেন নীতিমালায় উল্লেখ থাকতে হবে। জরুরী বিভাগ চালুর পর সরকারকে এটি মনিটরিংও করতে হবে। দেশে প্রতিদিন যত লোক হাসপাতালে আসার কিছু সময়ের মধ্যে মারা যান, হাসপাতালগুলোতে উপযুক্ত জরুরী স্বাস্থ্যসেবা কার্যকর থাকলে এর বড় অংশকেই হয়ত বাঁচানো সম্ভব।
×