ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম বন্দরে ‘লস্কর’ পদে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২১ নভেম্বর ২০১৭

চট্টগ্রাম বন্দরে ‘লস্কর’ পদে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দরে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ‘লস্কর’ পদে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে ব্যাপক তোলপাড় চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, বিষয়টি গড়িয়েছে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত। একাধিক সংসদ সদস্য এই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মাদারীপুর জেলার প্রার্থীদের প্রতি একচ্ছত্র পক্ষপাতিত্ব হয়েছে বলে অভিযোগ এনেছেন। তাছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে মহা অনিয়ম ঘটেছে বলে অভিযোগ বিভিন্ন উৎস্যুক মহলের। সংসদ সদস্যরা সরাসরি কারো নাম উল্লেখ না করলেও ইঙ্গিত নৌপরিবহনমন্ত্রীর দিকে। সোস্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি বন্দর নগরীতে হয়েছে মানববন্ধনসহ নানামুখী প্রতিবাদ। এর জন্য প্রধানত নৌপরিবহনমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। একই বক্তব্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষেরও। দায়িত্বশীল উর্ধতন কর্মকর্তারা বলছেন, জেলা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, পোষ্য কোটাসহ সকল ধরনের নিয়ম ও নির্দেশনা প্রতিপালিত হয়েছে নিয়োগের ক্ষেত্রে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবরকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন তারা। তারপরও প্রতিবাদকারীরা বলছেন, বিষয়টি সন্দেহের উর্ধে নয়। এ ব্যাপারে তদন্ত হওয়া উচিত। চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি বরাবরই আকর্ষণীয়। সে কারণে নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করলে হাজার হাজার আবেদন পড়ে। ‘লস্কর’ পদটির মর্যাদা চতুর্থ শ্রেণীর। লস্করদের কাজ জাহাজবাঁধা এবং পাহারা দেয়া। এই পদে আবেদন জমা পড়ে ৭৪ হাজার। ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় নিয়োগ পরীক্ষা। এ পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো কেন, সে প্রশ্নও উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার নিয়োগের ফল ঘোষিত হলে সেদিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয় যে, উত্তীর্ণ হওয়া ৯২ জনের মধ্যে ৯০ জনই নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নিজ জেলা মাদারীপুরের। আর চট্টগ্রাম থেকে নিয়োগ পেয়েছে মাত্র ২ জন। এ খবরে ব্যাপক তোলপাড় হয় সোস্যাল মিডিয়ায়। চট্টগ্রামে জনসাধারণের মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ফেসবুকে আসে অনেক বিদ্রƒপ ও মন্তব্য, যাতে চট্টগ্রাম বন্দরকে মাদারীপুরে স্থানান্তরের সরস দাবিও ওঠে। জাতীয় সংসদে বিষয়টি আলোচনায় আনেন চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য জাসদ নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল এবং জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলু। বাদল বলেন, ৯২ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন চট্টগ্রামে আর ৯০ জনই অন্য একটি জেলার। পদগুলোকে যদি সকল জেলায় ভাগ করে দেয়া হতো তাহলে চট্টগ্রামবাসী কিছু মনে করত না। জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে লোক নিয়োগ হয় অথচ চট্টগ্রামের মানুষ চাকরি পায় না। তিনিও বলেন, লস্কর পদে ৯২ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন চট্টগ্রামের। তিনি মেধা অনুযায়ী নিয়োগ না করার সমালোচনা করে বলেন, পক্ষপাতিত্ব ছাড়া যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়োগের এই বিষয়টি এতটাই আলোচিত হয়েছে যে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে নৌপরিবহনমন্ত্রীকে। রবিবার চট্টগ্রাম বন্দরে একটি কন্টেনার ইয়ার্ড উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নৌমন্ত্রী এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নিয়োগপ্রাপ্ত ৮৫ জনের মধ্যে ২৮ জনই চট্টগ্রামের। ৪০ জন চট্টগ্রামের বাইরের। ১৭ জন নিয়োগ পেয়েছেন পোষ্য কোটায়। মাদারীপুর থেকে চাকরি হয়েছে ৭/৮ জনের। জেলা কোটাসহ সকল ধরনের কোটা মেনেই এ পদে প্রার্থী নিয়োগ হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল এ প্রসঙ্গে বলেন, বন্দরের অবস্থান চট্টগ্রামে হলেও এই বন্দর শুধু চট্টগ্রামের নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় স্থাপনা, সারাদেশের বন্দর। বিষয়টি আঞ্চলিক ভিত্তিতে না দেখে সেভাবেই বিবেচনায় রাখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। এদিকে, নৌপরিবহনমন্ত্রী এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ লস্কর পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের বিষয়ে তথ্য প্রদান করলেও সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় থামেনি। সোমবারও এ নিয়ে ছিল নিন্দার ঝড়। এ নিয়ে বন্দর এলাকায় মানববন্ধনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবাদ কর্মসূচীতে সমর্থন রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদেরও। চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন সোমবার সিটি কর্পোরেশনের এক সড়ক সংস্কার কর্মসূচী উদ্বোধনকালে এই প্রসঙ্গে বলেন, সোস্যাল মিডিয়ায় ঢালাওভাবে যে অভিযোগ এসেছে, বাস্তবে তা ঠিক নয়। হাজারো প্রার্থী ছিল চাকরির জন্য। এর মধ্যে নেয়া হয়েছে মাত্র ৮৫ জন। সুতরাং অসন্তোষ থাকা স্বাভাবিক। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি নৌপরিবহনমন্ত্রী এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে, চট্টগ্রামের কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং পোষ্য কোটা ইত্যাদি মানা হয়েছে। মোট ২৬ জেলা থেকে যথাযথ কোটা ও নিয়ম মেনে মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বন্দরের নিয়োগ পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, চট্টগ্রামে পরীক্ষা অনুষ্ঠানে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে ৭৪ হাজার পরীক্ষার্থীকে বসানোর ব্যবস্থা চট্টগ্রামে নেই। এত বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর জন্য স্থান পাওয়া যায়নি বলেই ঢাকায় ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে নিতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এই জন্য চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদনও করা হয়েছিল। কিন্তু কারও পক্ষে এ সুুবিধা প্রদান করা সম্ভব ছিল না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, জেলা কোটা সংক্রান্ত সরকারের একটি নির্দেশনা রয়েছে, যে অনুযায়ী গেজেটও আছে। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো অসম্ভব। যিনি যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন, তাকে জেলা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, পোষ্য কোটা, নৃগোষ্ঠী কোটা এসব মানতেই হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে লস্কর পদে নিয়োগ নিয়ে যে প্রচার হয়েছে তা মূলত ‘ফেসবুক নিউজ।’ এ ধরনের খবরের কোন ভিত্তি নেই। নৌপরিবহনমন্ত্রী এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে আর কোন ধূ¤্রজাল থাকবে না বলে তার অভিমত।
×