ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ম্যানহোল থেকে লাশ উদ্ধার

রাজধানীতে মাদ্রাসা ছাত্রকে হত্যা,ঘাতক পলাতক

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ২১ নভেম্বর ২০১৭

রাজধানীতে মাদ্রাসা ছাত্রকে হত্যা,ঘাতক পলাতক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর গুলিস্তানে মোঃ জিদান (১১) নামে এক মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। সে মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। সোমবার ভোরে গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্সের কাছে ওই মাদ্রাসার ম্যানহোল থেকে তার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ। এদিকে হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী হাফেজ আবু বক্করের (১৬) নাম উঠেছে। ঘটনার পর থেকে সে পলাতক। পুলিশ তাকে গ্রেফতারে মাঠে নেমেছে। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত রক্তমাখা ছুরিটি উদ্ধার করা হয়েছে। পলাতক শিক্ষার্থী আবু বক্করের গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ থানার কালিকাফুর গ্রামে। পুরনো ঢাকার ওয়ারির জুগীনগরে থাকত তার পরিবারের লোকজন। পুলিশ জানায়, মুখবেঁধে হত্যার পর জিদানের মরদেহ কোলে করে ম্যানহোলে ফেলে মাদ্রাসার গেটের পাশের বেড়া ছিঁড়ে পালিয়ে যায় আবু বক্কর। ঘটনার পর পলাতক আবু বক্করের ভাই ও চাচাত ভাইকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া মাদ্রাসার চার শিক্ষার্থী ও কয়েক শিক্ষককে পল্টন থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অন্যদিকে সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে জিদানের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে তার লাশ গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার জালেশ্বর গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। নিহত জিদানের বাবার নাম মোঃ হাফিজ উদ্দিন। সে গুলিস্তানের ওই মাদ্রাসায় থাকত। নিহতের মামা জাবের হোসেন জুয়েল জানান, চার বছর আগে জিদানকে মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। সে হেফজখানা শিক্ষার্থী ছিল। ১৬ পারা কোরান মুখস্থ করেছে। জিদানের বাবা রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে মুরগি ব্যবসা করেন। ঠাটারিবাজারের বিসিসি রোডে সপরিবারে থাকেন। ৫ ভাই ১ বোনের মধ্যে জিদান সবার ছোট। পুলিশ জানায়, রাত প্রায় ৩টার দিকে মাদ্রাসার নূরানি বিভাগের শিক্ষক রাফসানির ঘুম ভাঙ্গে। পরে টয়লেটে যাবার সময় ফ্লোরের সামনে রক্ত দেখতে পান। এরপর তিনি অন্যদের ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। পরে তারা বাথরুমের পাশে ম্যানহোলে উপুড় হওয়া জিদানকে গলাকাটা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে মাদ্রাসার ম্যানহোল থেকে জিদানের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে। পল্টন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রেজাউল জানান, মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। মাদ্রাসার হেফজের কয়েক শিশুশিক্ষার্থী জানায়, আবু বক্কর এক বছর আগে হাফেজ হয়েছে। শিক্ষকদের আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০ পারা কোরান পড়ে শোনানোর পর মাদ্রাসা ছাড়ার কথা ছিল তার। আবু বক্কর মাদ্রাসার সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষার্থী। অন্য শিক্ষার্থীদের নেতা ছিল আবু বক্কর। সবাইকে তার কথা শুনতে বাধ্য করত সে। ওসব শিক্ষার্থী জানায়, কোরবানি ঈদের ছুটি শেষে মাদ্র্র্র্রাসায় ফেরার পর আবু বক্করের সঙ্গে জিদানের নানা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বাগবিতণ্ডা হয়। একবার এই ঝগড়া হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। পরে শিক্ষকরা তাদের বিষয়টি সুরাহা করেন। দু’জনকে একসঙ্গে মিলে থাকার নির্দেশ দেন। তবে শুধু জিদানের সঙ্গেই নয়। গত সপ্তাহেও আবু বক্করের সঙ্গে কয়েক শিক্ষার্থীর ঝামেলা হয়েছিল। ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের কাছে মাফও চান আবু বক্কর। মাদ্রাসা থেকে চলে যাওয়ার কথা বলে কাউকে কিছু মনে না রাখার ‘অনুরোধ’ জানিয়ে সবার কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেয় আবু বক্কর। সে সময় এক কথা বলার পর আবু বক্কর খুব গম্ভীর ছিল। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলত না। তারা জানায়, নিহত জিদান মাদ্রাসার যে ঘরে ঘুমাত। সেই একই ঘরে আরও ৪০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঘুমাত আবু বক্করও। ওই শিক্ষার্থীরা জানায়, মাদ্রাসায় ১০টার মধ্যে ঘুমানোর কথা থাকলেও শিক্ষার্থীরা গল্পগুজব করে রাতে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে ঘুমাত। ঘটনার আগেরদিন রবিবার রাত ১১টার দিকে আবু বক্কর গল্পগুজবের জন্য সবাইকে বকা দেয়। কথা কম বলে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে বলে। এ সময় মোঃ শফিকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একটি হাতঘড়ি চেয়ে নেয় আবু বক্কর। তারা জানান, রাত দেড়টার দিকে ঘর থেকে মেলামাইনের প্লেটের শব্দ পেয়েছে তারা। সরেজমিন মাদ্রাসায় ঘুরে দেখা গেছে, ৪০ শিক্ষার্থী ঘুমানোর রুম থেকে টয়লেট পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। জিদানের বালিশ, মশারি ও কাঁথায় ছোপ ছোপ জমাট বাঁধা রক্তের দাগ। এতে ধারণা করা হচ্ছে, হত্যার পর প্রথমে টেনেহিঁচড়ে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু টয়লেটে যেতে হলে অন্য শিক্ষার্থীদের ঘুমানোর রুম টপকে যেতে হয়। তাই পরে জিদানকে কোলে করে টয়লেটে নিয়ে ম্যানহোলে ফেলে দেয়া হয় বলে পুলিশ জানায়। এদিকে শফিউল নামের শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যে ঘড়িটি চেয়ে নেয় আবু বক্কর সেটি রক্ত মাখা অবস্থায় মাদ্রাসার বারান্দায় ফেলে যায়। শফিউল মাদ্রাসার বারান্দায় নিজের রক্তমাখা ঘড়িটি পড়ে থাকতে দেখে। শফিউলের দাবি, ভয়ে সেটি পাশের গুলিস্তান পার্কে ফেলে দেয় সে। পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর মাদ্রাসার হেফজের শিক্ষার্থী মোঃ রাফিউল, মোঃ হাবিবুল্লাহ, মোঃ রিয়াজ ও হাফেজ পাস ওমর ফারুককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পল্টন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাদ্রাসার কয়েক শিক্ষককে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মাহমুদুল হক জানান, এ ঘটনার মূল হোতা আবু বক্কর নামে এক শিক্ষার্থী। ঘটনার পর সে পলাতক। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে ঘটনার পর পুরনো ঢাকার ওয়ারি জুগীনগর থেকে ঘাতক আবু বক্করের ভাই ও চাচাত ভাইকে আটক করা হয়েছে। ওসি জানান, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের কারণে এই খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। সম্প্রতি জিদান ও আবু বক্করের সঙ্গে একটি ঘটনা নিয়ে আবু বক্করকে শাসন করেছিলেন শিক্ষকরা। এ থেকেই হয়ত সে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় নিহতের বাবা মোঃ হাফিজ উদ্দিন বাদী হয়ে পল্টন থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
×