ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

গণজোয়ারে ৭ মার্চের বিশ্ব জয়

প্রকাশিত: ০৩:১৭, ২১ নভেম্বর ২০১৭

গণজোয়ারে ৭ মার্চের বিশ্ব জয়

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাণী আজও সারা বাংলাকে শিহরিত করে, বাঙালী এক অপার সম্ভাবনাময় জীবন গড়ার প্রত্যয়ে নতুনভাবে জেগে ওঠে। এমন এক সমৃদ্ধ ভাষণ শুধু বাংলা ও বাঙালীর নয় বরং আজও তা বিশ্ব জয় করে পৃথিবীর স্মরণীয় ঐতিহ্যের সীমানাকেও স্পর্শ করেছে। ১৯৭১ সালের সামরিক জান্তার নির্মম চৌহদ্দীতে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে তার দেশত্ববোধের প্রজ্ঞায় যেভাবে সারা বাঙালীকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছিলেন সময়ের দুর্বার গতিতে সুদীর্ঘ ৪৬ বছর পর আজ তাবৎ বিশ্বকেও এক মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে গেছেন। অনেক দেরিতে হলেও সেই ঐতিহাসিক আর সমৃদ্ধ বক্তব্যটি বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি লাভের গৌরব অর্জন করে। জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ সংস্থা ইউনেস্কো ৭ মার্চের ঐতিহ্যিক ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ৭টি প্রামাণ্য দলিলে অন্তর্ভুক্ত করে বঙ্গবন্ধুকে যে মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে তা যেমন যুগান্তকারী একইভাবে বাংলা ও বাঙালীকে বিশ্বের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ আসনেও অধিষ্ঠিত করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এমন এক বিরল সম্মানের যথার্থ কর্ণধারই নন পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশ্বের যোগ্য নেতত্বেরও এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৭১ সালের ভয়াবহ, অগ্নিস্নাত রাজনৈতিক বিভীষিকাময় প্রেক্ষাপটে সারা বাংলা যখন উত্তপ্ত, দিশেহারা এবং বিপর্যস্ত সেই যুগ সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু ঠা-া মাথায়, স্থির চিত্তে, অবিচলিত কণ্ঠে যে উদাত্ত আহ্বান পথহারা জাতিকে নির্দেশনা দিয়েছিল তা আজও কতখানি প্রাসঙ্গিক এবং যুগোপযোগী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবন্ধুর দীপ্তকণ্ঠের সেই জোরালো আওয়াজ শুধুমাত্র একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় বরং প্রতিটি অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই আর সংগ্রামের বলিষ্ঠ প্রত্যয়। এমন বিপরীত স্রোতের পালহীন নৌকার সম্মুখ বিপর্যয়কে যে বক্তব্যে শাণিত আর উদ্দীপ্ত করেছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে এই রকম উপস্থিত কঠিন প্রত্যয় আর কোন নেতার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল কিনা তা সত্যিই গবেষণার প্রয়োজন আছে। তবে ইউনেস্কোর এই বিশ্ব স্বীকৃতি প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা পৃথিবীর ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের এক স্মরণীয় প্রামাণ্য দলিল। বিশ্ব জনীনতার অপার সম্ভাবনার বিস্তৃত সীমানায় বঙ্গবন্ধুর সদর্প বিচরণ বাঙালী জাতিকে গৌরবের যে শীর্ষস্থানে নিয়ে যায় তা শুধু বিস্ময়াভিভূত হওয়ার বিষয়ই নয় তার চেয়েও বেশি জাতির জনকের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের অনির্বাণ দীপ্তি সর্বোপরি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অদ্ভুত বাগ্মিতার এক অবিস্মরণীয় কথামালার নান্দনিক শৌর্য। প্রসঙ্গক্রমে এসেই যায় বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির সেই দুর্লভ সময়ের অভূতপূর্ব আনন্দের কথা। কবি রবীন্দ্রনাথই প্রথম তার সৃষ্টি সম্পদে বাংলা ও বাঙালীকে বিশ্বের দরবারে চিনিয়ে দিয়েছিলেন দুনিয়া তোলপাড় করে। বঙ্গবন্ধু ও তার সময়ের দাবিতে দেয়া বাণী সম্ভারে সারা বিশ্বকে চমক লাগিয়ে পৃথিবী জোড়া খ্যাতি বাঙালীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন। আর এই বরণীয় মুহূর্তকে আরও স্মরণীয় করে রাখার জন্য ঢাকার নাগরিক সমাজ সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আর এক জনসমাগমের আয়োজন করে। অগণিত লোকের এই মিলিত উৎসবে পুরো উদ্যান আনন্দের মিছিলে পরিপূর্ণ হয়। এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্বের পদচারণায় মুখরিত হয়। সব থেকে বেশি যাঁর উপস্থিতি দর্শকদের আনন্দে আপ্লুত করে তিনি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং সুদৃঢ় ক্ষমতায়ন দেশের সীমানা পার করে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত এবং নন্দিত। প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কোকে অভিনন্দন জানিয়ে ’৭১ সালের ৭ মার্চের সেই অবিস্মরণীয় দিনটিতে ফিরে যান। ভাষণের আগে মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব স্বামীকে যেভাবে সাহস আর প্রেরণা যুগিয়েছিলেন তাও শ্রদ্ধা, বিস্ময় আর বেদনার সঙ্গে স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আগে বেগম মুজিবের সেই আস্থাভাজন বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী আবারও জনগণের সামনে তুলে ধরেন ‘কোন কিছু নিয়ে ভাবার দরকার নেই তোমার মনে যে কথা আসবে তাই তুমি জনগণকে জানিয়ে দেবে।’ প্রসঙ্গক্রমে জাতির জনককে নিশ্চিহ্ন করার দুরভিসন্ধিও শেখ হাসিনা জনগণের সামনে তুলে ধরেন। ‘ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না’ সেই চিরায়ত বাণী আবারও নতুন করে সবাইকে জানিয়ে দিলেন। ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার ক্ষমতা কারোরই থাকে না। ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তির তো নয়ই। আর তাই বঙ্গবন্ধুকে বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস থেকে তো সম্ভবই নয় এমনকি বিশ্বের দরবারেও তাঁর সম্মানিত আসন চিরস্থায়ী হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল তিনি শুধু বাঙালীর নয় বিশ্ব মানবেরও। ইতিহাসের অমোঘ নিয়তি কোন ব্যক্তি মানুষের পক্ষে এমনি যায় না। বড় ধরনের সম্মান, ক্ষমতা, অর্জন কিংবা বিপর্যয়কেও ইতিহাস তার অপরিহার্য নিয়মের গতিতেই চালিত করে। যার সুফল-কুফল দুটোই বর্তায় সংশ্লিষ্টদের ওপর। বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও তাই হয়েছে যা তিনি সত্যিকার অর্থে পাওয়ার যোগ্য। আর ইতিহাস লঙ্ঘনকারীদের পরিণতিও ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট বলয়েই হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি কিংবা কখনও হবে না। মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ চেতনা লালন করা সাধারণ জনগোষ্ঠীকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয় যাতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতির ভবিষ্যত বিনির্মাণে সবার সক্রিয় অংশীদারিত্ব থাকে। যা চেতনা ধ্বংসকারী প্রতিপক্ষকে সমূলে বিনাশ করতে বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধু বাঙালীর জাতীয় জীবনের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যা যা করার দরকার ছিল সবটাই করতে চেয়েছেন তাঁর সাধ্যমতে। বেঁচে থাকা পর্যন্ত তাই করার সিদ্ধান্তে সব সময়ই অটুট থাকতেন। সেই প্রত্যয়ে নতুন শক্তিতে আবারও সবাইকে কঠিন ব্রতে সমস্ত বাধা বিঘœ অতিক্রম করে বীরদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পাকিস্তানী প্রেতাত্মাকে কোনভাবেই আর জেগে উঠতে দেয়া যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সুরক্ষিত রেখে প্রতিপক্ষ শক্তিকে প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় সবাইকে সংহত হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের শেষ মুহূর্তে পড়ন্ত বেলার অস্তায়মান রবির অন্তিম রশ্মি শেখ হাসিনার মুখে ছড়িয়ে পড়লে তিনি সেই আলোয় আলোকিত হওয়ার আহ্বান জানান উপস্থিত দেশবাসীকে। শেষ বিকেলের অস্তমিত সূর্যের নব কিরণে উদ্ভাসিত হয়ে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় তিনি আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এই বিশাল জনসমাগমের উদ্দীপ্ত আয়োজনটির নেতৃত্বে ছিলেন এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বরেণ্য কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও কথাশিল্পী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালও সভায় বক্তব্য রাখেন। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এই স্মরণীয় সমাবেশে উপস্থিত থেকে তাঁর জ্ঞানগর্ভ কথা জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন। দেশের বিশিষ্টজনেরাও ৭ মার্চের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ বক্তৃতা দেয়ার ক্ষমতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। শত্রু পরিবেষ্টিত বিরূপ পরিস্থিতি, দেশব্যাপী সামরিক জান্তার অসহনীয় আক্রোশে বিপন্ন জনগণ সব থেকে বেশি বঙ্গবন্ধুর নিজেরই নিরাপত্তাহীনতার এক অবর্ণনীয় অস্থিরতা সব মিলিয়ে সেই দুঃসময়টা অত সহজ, স্বাভাবিক এবং নির্বিঘ্ন ছিল না। সেই দুঃসহ কালপর্ব অতিক্রান্ত করাও ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম আর বাগ্্শক্তির অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে ভেতর থেকে তৈরি করে দিয়েছিল সময়ের মুখোমুখি হতে। দৃঢ় মনোবল আর অসম সাহসিকতায় বঙ্গবন্ধু নিজেও বুঝতে পারেননি কি সম্ভাবনাময় বাণী তিনি সাত কোটি বাঙালীকে উপহার দিচ্ছেন। সত্যিকারের ¯স্রষ্টা তাঁর সেরা সৃষ্টিটা আসলে নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেন। রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। এক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, পল্লীবালার নিভৃত জনপদে সৌন্দর্য বাংলার প্রাকৃতিক সম্ভারে রচিত গীতাঞ্জলির সে সব গানের বাণী তাঁর সৃষ্টির ঝঙ্কারে অনবদ্য হয়ে বিশ্ব দরবারে চলে যাবে সেটা কখনও তাঁর মনে হয়নি। বাস্তবে তাই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনটাই ছিল লড়াই আর দেশপ্রেমের উদ্দীপ্ত চেতনায় বাধাবিপত্তি পেরুনোর এক কণ্টকাময় সংগ্রামী অভিযাত্রা। যাকে তিনি দম্ভভরে আদর্শিক বোধে অতিক্রম করতে কখনও পিছপা হননি। চিহ্নিত শত্রুকে চেনার পরও সাবধান আর সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। যার মূল্য তাকে দিতে হয়েছিল বিভিন্নভাবে। শেষ পর্যন্ত পরিবারসহ প্রাণটাও অসময়ে, অপ্রয়োজনে হারাতে হয়েছিল। ২১ বছর জাতির জনকের নাম নিশানা মুছে ফেলার যে হীন চক্রান্তে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল শেষ অবধি তাদের পরাজয় অনিবার্য হয়েছে। ইতিহাস বিকৃতির জবাব ইতিহাসই সুষ্ঠুভাবে দিতে পেরেছে। ইতিহাসের দায়বদ্ধতাকে কেউ কখনও পাশ কাটাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। কিন্তু অশুভ আর প্রতিপক্ষ শক্তি ইতহাস থেকে শিক্ষা নেয়াকে আমলেই নিতে চায় না। তার দামও তাদের কড়ায় গ-ায় শোধ করতে হয়। আর ইতিহাসের সুযোগ্য নায়করা তাদের প্রাপ্ত আসনটি পেতে একটু দেরি হলেও এক সময় পেয়েই যান। খল নায়কদের গন্তব্যও তাদের নির্ধারিত জায়গায়। লেখক : সাংবাদিক
×