ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ॥ রাষ্ট্রহীন আশাহীন এক জনগোষ্ঠী

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২০ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ॥ রাষ্ট্রহীন আশাহীন এক জনগোষ্ঠী

‘নাচো’! ভয়ে আতঙ্কে কম্পমান মেয়েটির দিকে অস্ত্র উচিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল সেনা অফিসারটি। মেয়েটির নাম আফিফা। ১৪ বছরের বালিকা। কয়েক ডজন মহিলা ও অল্পবয়সী মেয়েসহ আফিফাকে খোঁয়াড়ের পশুর মতো একটা মাঠে এনে জড়ো করা হয়েছিল। ওরা সবাই রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়। গত অক্টোবর মাসের সেই দিনটিতে সকাল বেলা মিয়ানমারের সৈন্যরা সে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে আফিফাদের গ্রামে হানা দিয়েছিল। পুরুষ ও বালকরা প্রাণভয়ে জঙ্গলে ছুটে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল। দেহ তল্লাশির নামে ওদের শরীরে লোলুপ স্পর্শ সহ্য করার পর আফিফার চোখে পড়ল সৈন্যরা দুজন মহিলাকে ধানক্ষেতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর অন্যরা নজর দিল তার ওপর। অফিসার শাসিয়ে বলল : ‘এই মুহূর্তে তুমি যদি না নাচো তোমাকে আমরা জবাই করব।’ কান্নায় বাকরুদ্ধ আফিফা শরীরটাকে আগে পিছে এদিকে-ওদিকে দোলাতে লাগল। এর সঙ্গে তাল রেখে সৈন্যরা হাতে তালি দিতে থাকল। আর স্বয়ং অফিসারটি নিজের এক বাহু দিয়ে আফিফার কোমল জড়িয়ে ধরল। ‘এখন এটাই ভাল হলো তাই না?’ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল অফিসারটি। আফিফা যে ঘটনার কথা স্মরণ করেছে তা ছিল ২০১৬-১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাসরত প্রায় ১১ লাখ রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে তরঙ্গের পর তরঙ্গের আকারে সংঘটিত নারকীয়তার সূচনা। বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের অন্যতম হলো এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। বৌদ্ধদের প্রাধান্যপুষ্ট একটি দেশে এরা হলো মুসলিম জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গারা দাবি করে, তারা এদেশেরই সন্তান এবং তাদের অনেকে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বসতি স্থাপনের জন্য এখানে আগতদের বংশধর। ১৯৮২ সালে তদানীন্তন সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। তারা এখন মিয়ানমারে এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশে, যেখানে তাদের অনেকে পালিয়ে গেছে বেআইনী অভিবাসী হিসেবে। পাঁচ বছর আগে বৌদ্ধ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষে শত শত লোক নিহত হয়েছিল। তাদের বেশিরভাগই ছিল রোহিঙ্গা। তাদের গ্রামের পর গ্রামের ঘরবাড়ি, মসজিদ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে আশ্রয় শিবিরগুলোতে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী ওই ঘটনার ৪ বছর পর ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী চার মাসব্যাপী ত্রাসের অভিযান চালায় যার মধ্যে ছিল হত্যা, গণহারে আটক, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া এবং পাইকারি ধর্ষণ। সন্দেহভাজন রোহিঙ্গা জঙ্গীদের সীমান্ত চৌকিগুলোর ওপর পরিচালিত হামলায় ৯ জন পুলিশ নিহত হওয়ার পর সেনা অভিযান শুরু হলে প্রায় ৭৪ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয়। সম্প্রতি ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে তাদের হামলার বিস্তার ঘটালে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরগুলোর দিকে স্রোতের মতো ধাবিত হয়। ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর রোহিঙ্গা জঙ্গীদের হামলায় কমপক্ষে এক ডজন সদস্য নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনীর আক্রমণাভিযান শুরু হয়। শরণার্থীদের বিবরণে জানা যায় যে, সেনাবাহিনী নিষ্ঠুর কায়দায় ওই হামলার জবাব দেয়। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। শত শত রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। আফিফাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সৈন্যরা পাকা ধানক্ষেতে আগুন লাগায়, গরু-ছাগলগুলো হয় গুলি কওে, নয়ত নিয়ে যায়, ঘরের জিনিসপত্রও লুটে নেয়। ওদের পরিবারের ১১ জন সদস্যের ৫ জন গত মার্চ মাসে কোনভাবে বাংলাদেশে এক শরণার্থী শিবিরে এসে আশ্রয় নেয়। সে সময় ওর বাবা আমায় বলেছিল : ‘আমরা আমাদের বাড়িঘর ছেড়ে আসতে চাইনি। কিন্তু সেনাবাহিনীর লক্ষ্য ছিল একটাই; সব রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করা।’ মিয়ানমার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোরিয়ার ইয়াংখি লী বলেন, সেনাবাহিনীর এই হামলাগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে গণ্য হবার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। সেনাবাহিনী এমন বক্তব্য অস্বীকার করেছে। তেমনি অস্বীকার করেছেন অর্ধ শতাব্দীর সামরিক শাসনের পর মিয়ানমারের প্রথম সত্যিকারের সিভিলিয়ান নেতা আউং সান সুচি। বিবিসির কাছে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না কোন জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চলছে।’ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম পরিচালনার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আউং সান সুচি নির্যাতনকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা দূরে থাক, নির্যাতনের বিরুদ্ধে টু শব্দটি না করে মানবাধিকার কর্মীদের মর্মাহত করেছেন। গত জুন মাসে তার সরকার জাতিসংঘের নতুন তথ্যানুসন্ধানী মিকানের সদস্যদের ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা চল্লিশ বছরের দোকানমালিক মৌলভী জাফর বলেন, ‘আমাদের বড় আশা ছিল যে সুচি ও গণতন্ত্র আমাদের জন্য ভাল হবে। কিন্তু দেখা গেল যে, সহিংসতা আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। আমরা এতে ভীষণ অবাক হয়েছি।’ আফিফা, তার বাবা ও তিন ভাইবোন পাঁচ মাস ধরে পালিয়ে বেড়িয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যবর্তী নাফ নদী পাড়ি দেয়ার প্রথম দফা চেষ্টা চালানোর সময় মিয়ানমার সেনাদের একটি টহল বোট থেকে গুলি ছোড়া হয়। এতে তাদের নৌকাটি ডুবে যায় এবং বেশ কজন উদ্বাস্তু প্রাণ হারায়। শেষ পর্যন্ত তারা প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে যোগ দিতে সক্ষম হয়। এদের অনেকেই সীমান্ত সংলগ্ন নোংড়া অস্বাস্থ্যকর শিবিরিগুলোতে গাদাগাদি করে আছে। ওদিকে আফিফার মা ও আরও ৫ ভাইবোন মিয়ানমারের ভেতরে আত্মগোপন করে আছে। বালুখালিতে সম্প্রতি আগত প্রায় ১১ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু জঙ্গলময় পাহাড়গুলোতে পলিথিনে ঢাকা সাড়ি সাড়ি বাঁশের কুটিরে পরিণত করেছে। যাদের সেখানে ঠাঁই হয়েছে তারা অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান এবং তাদের একজন আফিফা। অন্যদের লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগের কাহিনী আরও করুণ। ৪০ বছরের নূর আয়েশা তার ঘোমটা সরিয়ে মুখমন্ডল জুড়ে পোড়া দাগ দেখাল। মিলিটারি এসে যখন তার ঘরে আগুন লাগায় তখন সে ঘরের ভেতরে। ১৪ বছরের কিশোর আজিম আল্লা আমাকে তার পুলিশের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে কুঁচকে যাওয়া বাম বহুটা দেখাল। গত অক্টোবর মাসে মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে তার তিন বন্ধু ওই রাতেই প্রাণ হারায়। নগান চুয়াং গ্রামের ২৭ বছরের ইয়াসমিন জানাল কিভাবে সৈন্যরা তার পাঁচ বছরের মেয়ের সামনে পালাক্রমে তাঁকে ধর্ষণ করেছিল। কিন্তু তার চেয়ে অনেক ভয়াবহ মুহূর্তটি এলো যখন সে তার ৮ বছরের ছেলেটিকে খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেল তার লাশ ধানক্ষেতে পড়ে আছে। পিঠে বুলেটের গর্ত। ইয়াসমিন বলে : ‘ওখানে আমাদের আর কোন আশা নেই।’ তার দুই চোখ বেয়ে তখন অশ্রু ঝরছিল। বাংলাদেশেও তাদের আশা বলতে তেমন কিছুই নেই। রোহিঙ্গারা উপযুক্ত চাকরি পায় না, বাচ্চাদের স্কুলে দিতে পারে না, মৌলিক স্বাস্থ্য সেবারও সুযোগ নেই। শিবিরের বাইরে রাস্তায় দলে দলে মহিলারা ভিক্ষা করে বেড়ায়। পুরুষরা ধানক্ষেত বা লবণের খামারে মাঝে মধ্যে কাজ পায় বটে, তবে দৈনিক মজুরি এক ডলারের বেশি কদাচিতই হয়। আর এমনিতেই গরিব, তার ওপর জনবহুল এই বাংলাদেশও তাদের বেশি দিন রাখতে চায় না। সরকার তাদের বঙ্গোপসাগরের প্রত্যন্ত একটা দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার কথা ভাবছে। শেষ বার আমি যখন আফিফাকে দেখি সে তখন আয়তাকার এক ধূলিময় জায়গায় ঝাড়ু দিচ্ছিল। আর ওর বাবা চার কোণে বাঁশের খুঁটি পুঁতছিল। ওটাই ওই পরিবারটির ভবিষ্যত কুটিরের স্থান। মোহম্মদ ইসলাম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পর সেদিনই প্রথম টুপি পাঞ্জাবি পরে জুমার জামাতে গিয়েছিল। কিন্তু ওদের দুর্ভোগ্যের তো শেষ নেই। গত মে মাসের শেষ দিকে এক ঘূর্ণিঝড়ে এই পরিবারের এবং বাউখালি উদ্বাস্তু শিবিরের আরও শত শত রোহিঙ্গার মাথা গোঁজার ঠাঁইগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়। কেউ অবশ্য মারা যায়নি। ইসলামের স্ত্রী ও অন্যান্য সন্তান শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে আসতে পেরেছে। তাই বলে সমস্যার শেষ নেই। খাদ্যাভাব প্রকট। এর মধ্যে রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযানের খবর এসেছে। এক প্রতিবেশী বিলাপ করে বলছেন, ‘আমাদের দুঃখের দিন কখনই শেষ হবে না।’ সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×