ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

বিএনপি প্রধানের ভাষণ ॥ বাঙালীর স্মৃতিভ্রম

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২০ নভেম্বর ২০১৭

বিএনপি প্রধানের ভাষণ ॥ বাঙালীর স্মৃতিভ্রম

গত ১১ নবেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না। বিএনপি লোক হত্যার রাজনীতি করে না। লোক হত্যার রাজনীতি করে আওয়ামী লীগ।’ বিএনপি ক্ষমতায় এলে অনেক মানুষ মেরে ফেলবে বলে ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপি মানুষ মারার রাজনীতি করে না।’ খালেদা জিয়া সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই সরকার হয়ত আপনাদের বলে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আপনাদের চাকরি যাবে, মামলা-হয়রানির শিকার হতে হবে। কিন্তু না। আমরা আগেই বলেছি, আমরা হিংসাত্মক রাজনীতি করি না। সরকারী আদেশ-নিষেধ মেনে চলাই আপনাদের দায়িত্ব। আমরা দেখব সরকারী চাকরিতে কে কতটা যোগ্য। সেখানে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ বলতে কিছু নেই। যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে তাদের চাকরি ও পদোন্নতি হবে। আপনারা নির্দ্বিধায় কাজ করতে পারেন।’ বাংলাদেশের ভোটাররা যখন পোলিং বুথে যান তখন হয়তবা তারা ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিশক্তিতে ভোগেন, নয়তবা তাদের সীমিত পছন্দের পরিধির কারণে তারা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেন না কোন্ রাজনৈতিক নেতারা তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। বিএনপি নেত্রী নিশ্চয়ই দেশের মানুষের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিশক্তির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেই তার ভাষণ তৈরি করেছেন, নতুবা তিনি কি করে ভাবলেন তার বিগত অন্ধকার আমলের অভূতপূর্ব দুঃশাসনের স্মৃতি মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে। বিগত ছেচল্লিশ বছরে বাংলাদেশের মানুষ সামরিক, আধাসামরিক এবং ‘গণতান্ত্রিক’ শাসন ব্যবস্থা অবলোকন করেছে; কিন্তু বিএনপির বিগত আমলের কুশাসনের সঙ্গে একমাত্র ’৭১ সালের গণহত্যাকারী পাকিস্তানী দখলদার শাসনের তুলনা করা চলে। তার সে শাসনে যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের কর্মী বা সমর্থক, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বাঁশখালীতে একই পরিবারের ১১ জনকে পুড়িয়ে মারাসহ যেভাবে সারাদেশকে এক মৃতপুরীতে পরিণত করা হয়েছিল তার তুলনা একমাত্র পাকিস্তানী গণহত্যাকারী এবং তাদের এদেশীয় অনুচরদের চরম নৃশংসতার সঙ্গেই তুলনীয়। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতন ও মৃত্যু নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। সরকারের সমালোচনাকারী, তিনি রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবী যেই হোন কেন, তার ওপর নির্যাতনের নিষ্ঠুর কৌশল, যেটা ঔপনিবেশিক শাসনের সময় চালু ছিল, সেটা আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। পাকিস্তানী আধা-ঔপনিবেশিক শাসনের সময়, যন্ত্রচালিত যন্ত্রের মতো অমানবিক কৌশল যেমন বৈদ্যুতিক শক, অন্ধবিন্দু নির্যাতন, রাজশাহী কারাগারে ইলা মিত্র এবং ঢাকার সেনানিবাসের তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের ওপর যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিল সেই একই ধরনের নির্যাতনের আবির্ভাব ঘটে। তার শাসনের কহিনুর মিঞাদের মতো পুলিশ অফিসারদের কথা কি মানুষ ভুলে গেছে যারা ঠা-া মাথায় মানুষ হত্যা আর নির্যাতন করেছে? এএসএম কিবরিয়ার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষটাকে শুধু গ্রেনেড মেরেই হত্যা করা হয়নি, তিনি যেন বেঁচে না উঠেন তার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র সুপরিকল্পিতভাবে অবহেলা দেখিয়েছে। ২১ আগস্টের মহাহত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে জজ মিয়া নামক এক নিরাপরাধ মানুষকে এ হত্যাযজ্ঞের একমাত্র আসামি করা হয়েছে। দেশের মানুষকে কতটুকু নির্বোধ ভাবলে এ ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করা যায় সেটা ভাবা কঠিন। এমনকি সরকার কর্তৃক গঠিত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি এই ঘটনায় বিদেশী ‘শত্রু’ দেশটির জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে। এ ধরনের বক্তব্য থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে? এ ধরনের অনেক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের রিপোর্ট একই ধরনের, যেখানে সরকারী কর্তৃপক্ষ দৃশ্যত ফৌজদারি এবং বিচারিক তদন্তের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার শাসনামলে ফৌজদারি এবং বিচারিক তদন্তের ওপর মানুষ সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলে। তার ‘সোনার ছেলেরা’ ২০০১ সালে নির্বাচন বিজয়ের পরবর্তীতে যে হত্যা আর অত্যাচার চালিয়েছিল সৌভাগ্যক্রমে আওয়ামী লীগের নির্যাতিত কর্মীরা তার কিয়দংশ প্রতিশোধও গ্রহণ করেনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের দলের মহাবিজয়ের পরও। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগ ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটে যে মানবাধিকার সম্মেলন করেছিল সেটা আহত আর অত্যাচারিতদের এক হাসপাতালে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের নিদারুণ মানবাধিকার পরিস্থিতিতে বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়ার প্রচেষ্টায় বিশ্বের অনেক রাজধানীতে আয়োজিত হয়েছিল মানবাধিকার সম্মেলন। এর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে ঠা-া মাথায় মানুষ হত্যা, যা হলো বিএনপি সরকারের সৃষ্ট এবং যা এখনও চলছে। যদিও এখন অনেক কম মাত্রায়। এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সমর্থনে একের পর এক বিএনপি মন্ত্রীরা বক্তব্য দিয়েছেন কড়া ভাষায়। তথাকথিত বাংলাভাই নামক দৈত্য সৃষ্টি করা হয়েছে বিএনপি নামক সরকারী দলের নেতাদের সহায়তায়, যিনি মানুষ হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছেন। যদিও বর্তমান সরকারের শাসনে মানবাধিকার পরিস্থিতি কোনভাবেই প্রশংসার অবস্থায় নেই, তবুও খোদা না করুক, বিএনপি সেটাকে যে গহ্বরে নিমজ্জিত করেছিল সেখানে পৌঁছতে এ সরকারকে দুরাচারিত্বের অনেক গহীনে নিমজ্জিত হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে একজন অপেশাদার রাজনৈতিক নিবন্ধকার হিসেবে দেশের বাইরে থেকেও গত দুই দশক যাবত মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন নিয়ে দেশের সর্বাধিক পঠিত ইংরেজী দৈনিকে আমি লিখছি। যারা আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত তাদের কাছে এটা প্রতীয়মান হবে যে, আমার সবচেয়ে কঠিন কথাগুলো সব সময় সরকার প্রধানের জন্য সংরক্ষিত থাকে, সেটা যে দলের সরকারই হোক না কেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের দিন থেকে যখন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, অত্যাচার ও হত্যা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন এবং ব্রিটিশ লর্ড সভাসহ বহু মানবাধিকার সংস্থাকে আলোড়িত করে, তখনও আমার লেখনীর শক্তি এতটুকুও দুর্বল হয়নি। সে সময় কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনার, যিনি আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন, আমাকে পরোক্ষভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন, সম্ভাব্য সরকারী প্রতিহিংসা এড়াতে ওই সময় বাংলাদেশে না যেতে। তিনি আমার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারণে যে চাকরিচ্যুত হতে পারেন সে আশঙ্কাও আমার কাছে প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তিনি একজন পেশাদার কূটনীতিক, বিএনপির রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। অবশ্য পরে তিনি একটা নিম্নস্তরের রাষ্ট্রদূত পদে কি কারণে বদলি হয়েছিলেন সেটা জানার আগ্রহ আমি প্রকাশ করিনি। ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টিতে আমাদের সেরা প্রতিভা নিয়োগের যুগোপযোগী প্রয়াস চারদলীয় জোটের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়। একজন প্রার্থীর যোগ্যতা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাসের এক আনুগত্য দ্বারা নির্ধারিত হওয়া শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থানসহ একাধিক স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত আমার এক ভাগ্নি আমাকে ফোন করে জানতে চাইল তারেক জিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে কি-না। কারণ জানতে চাইলে বলল, তারেক জিয়ার অনুমোদন ছাড়া কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়া অসম্ভব। সে অবশ্য একটি ফ্যাকাল্টি পদের জন্যও নির্বাচিত হয়নি, যদিও একাধিক শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব ছিল বিভাগে। আমার সম্পূর্ণ নিরহঙ্কারী ভাগ্নি, একটি নর্ম বিধবার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, এমনকি বাঙালী এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য কোন সময়ই ছিল না তার। অবশ্য জোট সরকারের ক্ষমতা শেষ হওয়ার পর থেকেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছে এবং সাফল্যের সঙ্গে অধ্যাপনা করছে। তবুও বিএনপি প্রধান জনসভায় বক্তব্য দিতে পারেন, ‘আমরা যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জনগণকে নিয়োগ করব, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি পরিচয়ে নয়।’ আমি যখন তার বক্তৃতা পড়ছিলাম তখন ওপরে বর্ণিত ভয়াবহ ঘটনাসমূহ আমার মানসপটে ভেসে উঠছিল। ভাবছিলাম বিএনপি প্রধান স্বভাবতই আমাদের লোকদের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতির ওপর ভর করেই তার অভিযোগ, অভিশংসন এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। খালেদা জিয়ার বক্তব্য পড়ে ভাবছি বাঙালীদের স্মৃতিভ্রম এতটাই প্রবল যে, মীর জাফর যদি পলাশীর যুদ্ধের পর অন্তত দশ বছর বেঁচে থাকতেন তাহলে বাংলার মানুষের ভোটেই তিনি নবাব নির্বাচিত হতেন! লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×